শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:৩৯:৩৩

নতুন মাত্রার চাপ বিএনপির ওপর

নতুন মাত্রার চাপ বিএনপির ওপর

হাবিবুর রহমান খান ও নজরুল ইসলাম : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর দল ও রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ঘটনা অনেকটা আকস্মিক। বিশেষ করে বিএনপির এই দুঃসময়ে তার পদত্যাগের ঘোষণা দলটির ওপর যেমন নতুন মাত্রার চাপ সৃষ্টি করেছে, তেমনি নানা সন্দেহের ডালপালাও বিস্তৃত হচ্ছে। কেউ কেউ এমনও ভাবতে শুরু করেছেন, এরপর বিএনপির আরও কোনো নেতা এভাবে দল ছাড়ার পথ বেছে নেবেন। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার বক্তব্য এ রকম সন্দেহের পালে আরও জোরে বাতাস দিয়েছে। যদিও বিএনপির তরফ থেকে বিষয়টিকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, এই পদত্যাগ দলের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ যুগান্তরকে তাদের মতামত জানাতে গিয়ে বলেন, সার্বিক প্রেক্ষাপট বিচার-বিশ্লেষণ করলে এমন ভাবাটাও অস্বাভাবিক হবে না যে, এই পদত্যাগের সঙ্গে যতটা না অসুস্থতা জড়িত; তার চেয়ে এই সময়ে শমসের মবিন চৌধুরীর দল ছাড়ার ঘোষণা দেয়াটাই যেন জরুরি ছিল। কেননা বিএনপিতে এমন বহু নেতা আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সেভাবে দলে সক্রিয়ও হতে পারছেন না। কিন্তু তাই বলে তারা পদত্যাগ করেননি। শমসের মবিন চৌধুরীর এমন পদত্যাগের ঘোষণায় শুধু বিএনপি নয়, পুরো রাজনীতির মাঠ নড়েচড়ে উঠেছে। ভবিষ্যৎ রাজনীতির হিসাব-নিকাশ নিয়েও চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব না দিলেও ক্ষমতাসীনরা লুফে নিয়েছে। এমনকি অতীতে শমসেরকে নিয়ে নানা কটূক্তি করা হলেও তার পদত্যাগের কিছুক্ষণের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, শমসের মবিনের পদত্যাগ এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া একই সূত্রে গাঁথা। তবে এ পদত্যাগের ফলে বিএনপির সাংগঠনিকভাবে তেমন ক্ষতি না হলেও কূটনৈতিক মহলে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ তিনি দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির পররাষ্ট্র বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও আছে। শমসের চলে যাওয়ায় এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও শূন্যতা সৃষ্টি হবে। তার লবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বিএনপি যে সুফল পেত তা থেকে দল কিছুটা হলেও বঞ্চিত হবে। এদিকে শমসের মবিনের দল ত্যাগের সঙ্গে কেউ কেউ সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার সঙ্গে যোগসূত্রতা তালাশ করছেন। কেননা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে একান্তে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন ব্যারিস্টার হুদা। এছাড়া এক সময় নাজমুল হুদা ও শমসের মবিন ছিলেন জিয়াউর রহমানের খুবই ঘনিষ্ঠ। বিগত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের মতো বিএনপিকে ভাঙার কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা রাজনৈতিক অঙ্গনে সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আগামী ৪ নভেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই আহমেদ কামালের এক মিলাদ মাহফিলকে কেন্দ্র করে এই সন্দেহ এবং অবিশ্বাস আরেক নতুনমাত্রা যোগ করেছে। তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সরকার নানা চাপে ফেলে দলের মধ্যে সাময়িক অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত দলে ভাঙন তৈরি করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন বলেন, শমসের মবিনের পদত্যাগে বা রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো চাপ ছিল কিনা জানি না। তবে এর ফলে বিএনপিতে একটা প্রভাব তো পড়বেই। কিছুটা হলেও দলের ক্ষতি হবে। কারণ তাদের বেশির ভাগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা যেমন রয়েছে, তেমনি অনেকে আছেন কারাগারে। রাজপথে সক্রিয় নেতাকর্মীর অভাবও রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে শমসের মবিন চৌধুরী দল বা রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন দেশে নেই, এ মুহূর্তে উনার রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা জরুরি ছিল কিনা এটা উনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে হঠাৎ করে তার এ ঘোষণা আলোচনার দাবি রাখে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো একজন ব্যক্তির পদত্যাগে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কোনো দল শক্তিশালী বা দুর্বল তা জনগণই ঠিক করে। গত নির্বাচনে ভারতের কংগ্রেস হেরে গেছে, বিজেপি জয় লাভ করেছে। এখন সেখানে বিজেপি শক্তিশালী। তেমনি বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হতেই হবে। সেখানে জনগণ যে দলের পক্ষে রায় দেবে তারা যেমন সরকার গঠন করবে ঠিক তেমনি সেই দলও তখন শক্তিশালী হবে।’ শমসের মবিনের পদত্যাগের পর বিএনপিতে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে যে দাবি তোলা হচ্ছে তা নাকচ করে দিয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপিতে কোনো ভাঙন নেই। বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতারা এ ধরনের কথা বলতেই পারে। বিএনপি কখনও ভাঙেনি। গত ৩৫ বছরে বিএনপি অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেছে এবং ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে সরে গেছে বলে শমসের মবিন যে দাবি করেছেন, তা একান্তই তার ব্যক্তিগত ভাবনা। বিএনপি জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। দল জিয়ার আদর্শেই পরিচালিত হচ্ছে।’ শুক্রবার সিলেটের একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ‘এ ধরনের রাজনীতি; দল ভাঙা-গড়ার নোংরা খেলা অতীতে হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। আওয়ামী লীগও বহুবার ভাঙনের মুখে পড়েছে। তাই বলে কি আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে গেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, বিএনপি দেশের সর্ববৃহৎ দল। তাই এ দল থেকে দু-একজন চলে গেলে কোনো ক্ষতি হয় না।’ তিনি বলেন, ‘শমসের মবিনের পদত্যাগে কারও কারও মনে হতে পারে, বিএনপিতে ভাঙন বা অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির দাফন হয়ে গেছে কিংবা হিমঘরে চলে গেছে। কিন্তু সেটা তাদের ধারণামাত্র। বাস্তবে কিছুই না। এই দল যখন জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে তখন সবাই আবার ঐক্যবদ্ধ হবে। কারণ বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থকসহ সব জনশক্তি এখন পরিস্থিতির কারণে ঘুমন্ত বাঘে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সময়মতো ঠিকই গর্জন দিয়ে উঠবে। এও ভাবতে পারেন, বিএনপি এখন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। তাই যে যার খুশিমতো আচরণ করছেন, আগ্নেয়গিরির ওপর দিয়ে চলাফেরাও করছেন। কিন্তু জনগণ যখন সত্যিই ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে, তখন জেগে উঠবে। সে সময় জনগণের দল হিসেবে বিএনপি আরও শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হবে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন, ঠিক সেই সময় শমসের মবিন চৌধুরী দল থেকে পদত্যাগ বা রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এ মুহূর্তে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে দলের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা গুরুতর অসুস্থ। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ছাড়াও দলের প্রবীণ নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আরএ গনি, এম শামসুল ইসলাম, সরোয়ারী রহমানসহ দলের সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতা অনেক দিন থেকেই গুরুতর অসুস্থ। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমকে আনোয়ার, রুহুল কবির রিজভীসহ কারাগারে আটক নেতারাও অনেকে অসুস্থ। সেই তুলনায় শমসের মবিনের শারীরিক অবস্থা অনেকটা ভালো বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের সামনে তাকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। আর যদি তিনি গুরুতর অসুস্থই হতেন তাহলে লোকমারফত পদত্যাগের বার্তা পাঠিয়ে দিতেন। গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে পারতেন না। তাই এসব যুক্তি সামনে নিয়ে এলে শমসের মবিনের পদত্যাগ ও রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার পেছনে অসুস্থতাই মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ নেই। এর পেছনে ভিন্ন কোনো কারণ বা চাপ থাকতে পারে। বিএনপির একজন নেতা বলেন, এ রকম সন্দেহকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন শমসের মবিন নিজেই। কেননা তার জানামতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চেয়ারপারসন আসা পর্যন্ত তাকে পদত্যাগ না করে অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সে অনুরোধ তিনি রাখেননি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ‘শমসের মবিনের পদত্যাগ অপ্রত্যাশিত। দলের কারও সঙ্গে আলোচনা করে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে হয় না। দলের কারও সঙ্গেই তার দূরত্ব ছিল না।’ তার পদত্যাগে দলে কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিন্দুকেরা অনেকেই অনেক কথা বলবেন। নেতাকর্মীদের বলব, গুজবে কান দেবেন না।’ বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ওয়ান-ইলেভেনে অনেকেই দল ছেড়েছিলেন তাতে দলের কিছুই হয়নি। বিএনপি জনগণের দল। এ দলকে জনগণই টিকিয়ে রাখে।’ বিএনপির চেয়ারপারসনের অপর উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘আরও কেউ কেউ বিএনপি বা রাজনীতি ছেড়ে দিতে পারে বলে ক্ষমতাসীনরা যে কথা বলছে তা অনেকটা হাত দেখার মতো ‘ভবিষ্যদ্বাণী’। বিএনপির আরও অনেক নেতা রাজনীতি ছেড়ে দেবেন এমন ধারণা করে খুশি মনে ‘বগল’ বাজাচ্ছে। তাদেরকে বলব নিজেদের সংগঠনের দিকে নজর দিন। বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় যাবে, আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারাবে। কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে তারা ক্ষমতা হারায়। অতএব ক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বিএনপিতে আসবেন।’ তিনি বলেন, ‘শমসের মবিন অসুস্থ, তার বয়সও হয়েছে। তিনি অবসর নিতেই পারেন। তার সুস্থতা কামনা করি। তাই আমি ক্ষমতাসীনদের বলব, আওয়ামী লীগের যেসব নেতার বয়স হয়েছে, তারাও শমসের মবিনের মতো অবসর নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।’ -যুগান্তর ৩১ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে