শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:০১:৪০

একজন শমসের মবিন ও রাজনীতি

একজন শমসের মবিন ও রাজনীতি

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : হঠাৎ করেই রাজনীতি ছাড়লেন শমসের মবিন চৌধুরী।এ নিয়ে গেল দুই দিন ধরে প্রকাশ্যে-অন্দরমহলে চলছে রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ। আলোচনা-সমালোচনার ঝড়ে রাজনীতির অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত।দুই শিবিরেই বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।তবে বিরোধী শিবিরের চেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে ক্ষমতাসীন মহলে। বিষয়টি এতটাই ঝড় তুলেছে যে তা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও সুবাস ছড়িয়েছে।ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের ভাষ্য-উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছে তারা বিশ্ব বিজয় করেছেন।এই জানি- বিএনপির রাজনীতি বেনিশ হয়ে গেল।অন্যদিকে বিরোধীদের ভাষ্যমতে এ যেন কোনো ঘটনাই নয়, মামুলি একটা বিষয়।আসলে বিষয়টি সেরকম, না অন্য কিছু।ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তণ ছাত্র ও একজন নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে নিজেকে একেবারে চুপ থাকতে পারলাম না।তাই আজ দু'কলম লিখতে বসলাম। প্রথমেই আসি শমসের মবিন চৌধুরীর কথায়।রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা।সম্পূর্ণ শারীরিক কারণে অবসর নিয়েছি।আমি বাইরে যেতে পারি না, আমার চলাফেরার মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।এ অবস্থায় রাজনীতি করতে হলে যে ধরনের শ্রম, সময় দেওয়া প্রয়োজন, সেটা আমার পক্ষে শারীরিক কারণে সম্ভব হচ্ছে না।’ ‘চিকিৎসার জন্য আমার বিদেশে যাওয়া জরুরি।এমআরপি পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিয়েছি।হাতে পেলেই যেতে চাই।এ কারণে বিএনপির সব পদ থেকে সরে গিয়ে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন থেকেই তা কার্যকর হবে।’ এরপর আসি সরকারী মহলের উচ্ছ্বাস বাণীর বিষয়ে।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ‌‘বিএনপি ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। মুক্তযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আরো অনেকেই বিএনপি ছাড়বে’ সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‌‘সমশের মবিনের রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা বিএনপির নেতিবাচক রাজনীতির হতাশাব্যঞ্জক বহিঃপ্রকাশ।’ নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান বলেছেন, ‘আরও অনেকেই বিএনপি ছাড়বে।’ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‌‘বিএনপির প্রতি নেতাদের ভরসা নেই, তাই আরও অনেক নেতাই বিএনপিকে গুডবাই জানাবেন।’ এর জবাবে বিএনপির নেতারা যা বলেন।বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপি একটি বিশাল দল। এখানে হাজার হাজার নেতা তৈরি হয়। একজনের ওপর কখনো দল নির্ভর করে না।সুতরাং শমসের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগে দলের কিছুই হবে না।’ নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘শমসের মবিনের উপর চাপ তৈরি করে ক্ষমতাসীনরা দল ছাড়তে বাধ্য করেছে। এটা তাদের দুঃস্বপ্ন। কারণ বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পলায়নপর ছিল তারাই মূলত জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও কৌতুহল সৃষ্টির জন্য নানা কথা বলছেন।আওয়ামী লীগকে তিনি বলেন, ‘বিএনপির কে কে চলে গেল সেদিকে খেয়াল না করে নিজেদের ঘর সামাল দেন।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে নেই।এই অবস্থায় দলের কারও সঙ্গে আলোচনা না করে তার অবসরের সিদ্ধান্তে আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। অদৃশ্যমান কোন ঘটনা থাকলে মবিনকে ফেরানো সম্ভব নয়।’ এছাড়াও আমাদের গণমাধ্যমগুলো তৃতীয় আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে। সেটা হলো শমসের মবিনের এই পদত্যাগকে নিয়ে নানা রসাত্মক গল্প আবিষ্কার করছে। যে যেভাবে পারছে তাই প্রচার করছে। যেমনটি উল্লেখ করা যেতে পারে- কোনো মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে তারেক রহমানের অসদাচারণ কিংবা উপেক্ষার জন্য, দলে উপেক্ষিত, জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ না পেয়ে হতাশ, দল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় পদ হারানোর আশঙ্কা কিংবা সরকারের সাথে গোপন আঁতাতের কারণেই শমসের মবিন রাজনীতি ছেড়েছেন।এ ধরেনর আরো নানা কাহিনী প্রচার হচ্ছে।তাই বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে।রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তণ ছাত্র হিসেবে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সরকার সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যয়ন করে এবং গেল তিন দশক ধরে দেশের রাজনীতির চিত্র দেখে যা বুঝেছি সেই আলােক নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ নিম্নে তুলে ধরলাম। এক. আজকে যারা এ নিয়ে বিতর্ক করছেন তারাসহ দেশবাসীর কাছে প্রথমেই প্রশ্ন রাখতে চাই, জীবনের জন্য রাজনীতি, না রাজনীতির জন্য জীবন। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির কাছে রাজনীতি বড়, না তার জীবন বড়? অবশ্যই কেউ বিকৃত মস্তিষ্ক না হলে একবাক্যে সবাই বলবেন, জীবন বাঁচানোই বড়।যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরী তো সেই কথাই বলেছেন। তিনি হয়তো আরো বলতে চেয়েছন, জীবন সায়াহ্নে প্রচলিত হানাহানি রাজনীতির নিপীড়ন সইবার শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন।বিগত দিনে জেলখেটে-রিমাণ্ডে নির্যাতনে তাঁর শারীরিক শোচনীয় অবস্থাও আমরা দেখেছি।কেননা, ইতোপূর্বে অনেক নেতাকে আমরা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে দেখেছি।ফলে জীবন রক্ষায় তাঁর এই সিদ্ধান্তকে আমাদের সমীহ চোখেই দেখা উচিত। দুই. শমসের মবিনের রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের ঘটনায় ক্ষমতাসীন শিবিরের উচ্ছ্বাস প্রকাশ কিংবা বিরোধী শিবিরের মনোক্ষুন্ন হবার মত কোনো বিষয় আছে বলে মনে হয় না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা অতীতে সরকার পরিচালনায় পররাষ্ট্রনীতিতে মবিনের অনেক অবদান থাকতে পারে।কিন্তু দেশের রাজনীতিতে তাঁর কোনো ক্যারিয়ার কিংবা অবদান আছে বলে অন্তত: আমার জানা নেই। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করেন সর্বশেষ সচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে চাকুরি থেকে অবসর নেন। এইত কিছু সময় আগে তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে পদ পান। ফলে একজন আমলা হিসেবে তাঁর যতটা গুরুত্ব বহন করে, রাজনীতিবিদ হিসেবে এর সিকি অংশও দেখছি না।দলের ভেতরে বাইরে তাঁর কোনো বিশাল কর্মীসমর্থক ছিল বলেও আমার জানা নেই। ফলে মবিনের অবসরে বিএনপির রাজনীতিতে বড় ক্ষতি হবে সে ধরনের দুশ্চিন্তার কোন কারণও দেখছি না। এছাড়া তিনি তো আর অন্যদের মত ডিগবাজি দিয়ে অন্য দলেও যোগ দেননি।সেহেতু এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী শিবিরের খুশি হবার মতোও কোনো কারণ নেই। তিন. একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ বিজ্ঞ আমলা হিসেবে যার দেশের জন্য অনেক অবদান রয়েছে, আমরা তাঁর কথায় বিশ্বাস রাখতে চাই যে-তিনি নীতি-নৈতিকতা ও অতীতের সব অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে কোনো ধরনের গোপন আঁতাতে এই কাজটি করেননি।সম্পূর্ণ জীবন রক্ষায় এ কাজটি করেছেন।যদিও মামলা-হামলা নিপীড়ন এক ধরনের চাপ হিসেবেই কাজ করেছে।তবে সেটা দেশবাসীর কাছে কোনো নেতিবাচক হিসেবে বার্তা দেয়নি।অবশ্য সামনের দিনে এটা আরো সুষ্পষ্ট হবে মি. মবিনের কর্মকাণ্ডেই।ফলে বিএনপির এ মুহূর্তে কোনো বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো সঠিক হবে না।কেননা, তিনি অবসর নিলেও বলেছেন, শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পেলে রাজনীতির বাইরে থেকেও তিনি দেশ-জাতির স্বার্থে আজীবন কাজ করবেন।বিএনপি বিষয়টি কীভাবে নিচ্ছে জানি না, তবে আমরা মনে করি, কারও রাজনীতি করার যেমন অধিকার থাকে, তেমনি না করার অধিকারও থাকে।সেই জায়গা থেকে মি. মবিনের প্রতি বিএনপির নেতাকর্মিদের ক্ষোভ প্রকাশ কোনোভাবেই কাম্য নয়।যদিও বিএনপির এই সঙ্কটময় মুহূর্তে এভাবে সরে দাঁড়ানো ঠিক হয়নি। চার. এর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর একটি নিবন্ধে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এর মধ্যে সরকারের চাপ সামলিয়ে সুকৌশলে দলীয় নেতাকর্মীদের দলে ধরে রেখে সামনের দিনে রাজনীতি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। দেরিতে হলেও আজ সেই লক্ষণই দৃশ্যমান হচ্ছে।সামনে এই চ্যালেঞ্জ আরো প্রখর হতে পারে। কেননা, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে যেখানে অসহিষ্ণু রাজনীতি সেসব দেশের ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই মনে করে এভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করতে পারলে কিংবা বিরোধীদের দমন করা গেলে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হতে পারে। যদিও বাস্তবে এর ফল ভিন্ন। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, স্বার্থের কারণেই হোক আর মামলা-হামলা নীপিড়নের চাপেই হোক সামনের দিনে বিএনপি থেকে আরো বেশ কিছু নেতাকর্মী সরে দাঁড়াতে পারে। সরকারও সে পথেই হাঁটছে বলে তাদের কাজে কর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই বিএনপির জন্য মি. মবিন পূর্ব সতর্ক হতে পারে। তবে এটা সত্য যে, বিএনপির মত একটি বৃহৎ দলকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সরানো কিংবা মুছে ফেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বরং অতীতে যারা দেশকে বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা করেছে তারাই মূলত: কলঙ্কিত হবে। পাঁচ. সরকারি মহল স্বীকার করুক আর নাই করুক এটা সত্য যে- সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ভেতরে বাইরে বড় ধরনের অস্বস্তির চলছে। বিশেষ করে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যা, তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলায় এবং বিদেশীদের চাপে সরকার অনেকটাই বেসামাল ও অস্বস্তিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে তারা বিরোধীদের দুর্বল করাকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে। এছাড়া রাজনীতির অন্দরমহলে নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। যা সত্যতা মিলেছে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যেও। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। আওয়ামী লীগের ভাষায় এটা ষড়যন্ত্র হলেও এটা মূলত অন্দরমহলের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। সামনের দিনে এটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। তবে অন্দরমহলের এই রাজনীতি ফলাফল পেতে দেশবাসীকে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে এমনটাই ধারণা অনেকের।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে