রবিবার, ০৬ আগস্ট, ২০১৭, ০৪:৫৪:০১

অবশেষে তার দেখা পাওয়া গেল

অবশেষে তার দেখা পাওয়া গেল

রাজীব নূর: অবশেষে তার দেখা পাওয়া গেল। আগস্টের ৩ তারিখ, রাত ১০টায়। মাত্র দু'দিন পরেই চিকিৎসা করাতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তাই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন তারই কয়েকজন ভক্ত-শুভানুধ্যায়ী।

এর আগে তাকে শুধু ছবিতেই দেখা হয়েছে আমার। তিনি এলে দেখলাম, ছবির মতোই আছেন এখনও, শুধু কাঁচা-পাকা চুল-দাড়ি পুরো সাদা হয়ে গেছে। দু'দিন পর ঊরুসন্ধির হাড় প্রতিস্থাপন করাতে যাচ্ছেন যে মানুষটি, তাকে এমন দৃঢ়তার সঙ্গে কারও সাহায্য ছাড়াই হেঁটে আসতে দেখে বিস্ময় লাগল। তিনি এসে দরজায় দাঁড়াতেই তার শ্বেতশুভ্র চুল-দাড়ি দেখে মনে হলো, 'অমল ধবল পালে লেগেছে/ মন্দ মধুর হাওয়া'।/ দেখি নাই কভু দেখি নাই/ এমন তরণী বাওয়া।'

সত্যি তাই, বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্যপুরুষ নামে পরিচিত সিরাজুল আলম খান সেই ১৯৬৫ সালের পর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে এমন তরণী বেয়েছেন, যা আর কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। অথচ এর আগে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত পরপর দুই দফা ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বাঙালির জাতিরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেছিলেন গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াস স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামেও পরিচিত ছিল। ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১-দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়নে এই নিউক্লিয়াসের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে 'জয় বাংলা'সহ যাবতীয় স্লোগান নির্ধারণ এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বাক্যবন্ধ সংযোজনের কৃতিত্বও অনেকাংশে এই নিউক্লিয়াসেরই বলে মনে করা হয়।

সাধারণ্যে 'দাদাভাই' নামে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের জন্য অপেক্ষার অবসরে তার একান্ত ঘনিষ্ঠজন সাবেক সংসদ সদস্য, রাজনীতি অধ্যয়ন ফোরামের মডারেটর অধ্যাপক হুমায়ূন কবীর হিরু বলছিলেন, 'দাদাভাই ভুগছেন নানান শারীরিক জটিলতায়। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত এই মানুষটি নিজেই নিজের দেখাশোনা করেন। আগে দু-দু'বার হয়েছে বাইপাস সার্জারি। এখন যাচ্ছেন অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য একটি অপারেশান করাতে। ঊরুসন্ধির ক্ষয় হয়ে যাওয়া হাড়ের পরিবর্তে কৃত্রিম হাড় প্রতিস্থাপন করতে হবে। সে জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো প্রয়োজন। ব্যক্তিগত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনসহ বর্তমান সমাজের অনেক কিছুতেই বিশ্বাস করেন না তিনি। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন এবং কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। নিজে কোথাও যান না। ১৯৬৫ সালের পর আর কখনও সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দেননি। পত্রপত্রিকায় বিবৃতি-সাক্ষাৎকার দেন না বহুকাল। সর্বশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আশির দশকে জেল থেকে বেরোনোর পর সেই সময়ের আলোচিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। কোনো রাজনৈতিক ঘটনা, রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে কথা বলায় রয়েছে অনাগ্রহ। এমনকি নিজ হাতে গড়া রাজনৈতিক দল জাসদ থেকে শুরু করে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই তার। তবে সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।

সাক্ষাৎ পেয়ে সিরাজুল আলম খানের কাছে জানতে চাই- সামাজিক গণতন্ত্র বলতে কী বোঝাতে চান? প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রবল অনাগ্রহ তার। পাল্টা জানতে চান, 'তুমি কি আমার লেখাজোকা কিছু পড়েছ?' যৎসামান্য পড়া আছে বলতেই জানতে চান, 'তাহলে তুমিই বল সামাজিক গণতন্ত্র বলতে কী বোঝাতে চাই আমি?' উত্তরে বলি, 'ব্যক্তি-পরিবার এবং সমষ্টিগত পর্যায়ে উৎপাদন-বণ্টনের ক্ষেত্রে শ্রম-কর্ম-পেশার সর্বস্তরে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর করার প্রশ্নে ব্যক্তির অধিকার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।' এবার একটু সহজ হলেন সিরাজুল আলম খান; বললেন, দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ও ফেডারেল সরকার গঠন করতে হবে। প্রাদেশিক সরকার ও প্রাদেশিক পরিষদ, স্বশাসিত উপজেলা পরিষদে শ্রম-কর্ম-পেশার প্রতিনিধিত্ব, সিটি করপোরেশনগুলোতে মেট্রোপলিটন সরকার, প্রবাসীদের অর্থায়নে প্রতি উপজেলা ও পৌরসভায় শিল্পাঞ্চল, উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট, মেগা-সি-পোর্ট ও কানেকটিভিটি, পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। তার মতে, '১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যে সংবিধান রচনা ও কার্যকর করা হয়, তা ব্রিটিশ, ভারত ও পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর অনুকরণে প্রণীত। এই সময় থেকেই বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসন ব্যবস্থার শুরু। এটি কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের চেতনাবিরোধী।'

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সিরাজুল আলম খানের চাওয়া ছিল 'অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনর্গঠনের একটা পর্যায় পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি বিপ্লবী জাতীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব দলের সমন্বয়ে গঠিত এই সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু।' মহিউদ্দিন আহমদের 'জাসদের উত্থান পতন :অস্থির সময়ের রাজনীতি' বই থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে নতুন রাষ্ট্রটি কীভাবে পরিচালিত হবে, সে জন্য যে ১৫ দফা কর্মসূচি- এ চাওয়াটি ছিল তার প্রথম দফা। অন্য দফাগুলোতে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত নেতৃত্ব দ্বারা, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন। বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনবোধে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন। তাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে। বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে; কোনো দেশের অনুকরণে নয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব দলের প্রতিনিধিদের একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হবে। চিরাচরিত সেনাবাহিনীর পরিবর্তে জাতীয় পর্যায়ে রেভল্যুশনারি গার্ড গঠন, জেলা-মহকুমা-থানায় কমপক্ষে দুই-তিন বছর প্রশাসনের কোনো ক্যাডার না রাখা, মুক্তিযোদ্ধাদের জনপ্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া, সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১ :৭ করার প্রস্তাবও ছিল। মহিউদ্দিন আহমদের বই থেকে জানা যায়, 'কর্মসূচিটি একঝলক দেখে শেখ মুজিব সেটা তার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেন। ড্রয়ার থেকে সেটা আর বের হয়নি।'

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলের সমন্ব্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের হাত ধরে প্রথমে কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং পরে ৩১ অক্টোবর জন্ম হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) এমএ জলিলকে সভাপতি এবং ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রনেতা আ. স. ম. আবদুর রবকে সাধারণ সম্পাদক করে জাসদের প্রথম কমিটি গঠিত হয়। তবে নতুন এই দল গঠনের মূল সংগঠক সিরাজুল আলম খান থেকে যান আড়ালে। ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৭ শতাংশ ভোট পেলেও জাসদকে কেন্দ্র করেই উথাল-পাতাল রাজনীতির বিস্তার ঘটেছিল। মহিউদ্দিন আহমদ তার বইয়ে লিখেছেন, 'বাহাত্তর সালটা ছিল জাসদের উত্থানপর্ব, তেহাত্তর-চুয়াত্তরে ভরা যৌবন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই দলটি সংকটে পড়ে। কেননা, পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে যায় পুরোপুরি। ছিয়াত্তর থেকে শুরু হয় ভাটার টান। একদিকে অস্তিত্বের সংকট, অন্যদিকে ভাঙনপর্ব।'

জাসদে ভাঙনপর্ব শুরুর আগে আগে জেল থেকে ছাড়া পান সিরাজুল আলম খান। ছাড়া পেয়ে আর তেমন একটা সক্রিয় হননি জাসদে এবং ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে পুরোপুরিই সরে যান। তবে রাজনীতি নিয়ে নিজের মতো চিন্তা করেন সব সময়। তার অনুসারীদের একজন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোটের চেয়ারম্যান মহিনউদ্দিন চৌধুরী বিপ্লব বলেন, 'দাদা আশির দশকের শুরু থেকেই বলছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় সামাজিক শক্তিগুলোকে স্পেস দিতে হবে। তার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে অদলীয়ভাবে নির্বাচিত শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বের জন্য ২০০ আসন রয়েছে।'

গত ৩ আগস্ট রাতের আলাপচারিতায় সিরাজুল আলম খানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, রাজনৈতিক দল ছাড়া তার সামাজিক গণতন্ত্র বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? উত্তরে বলেছেন, 'তুমি বাসা বানাইয়া না দিলে মুরগি কি আন্ডা (ডিম) দেবে না?' ততক্ষণে তার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারছিলাম, উত্তরটা তিনি দেবেন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। তিনি বললেন, 'কত পার্সেন্ট লোক রাজনীতি করেন? বড়জোর তিন থেকে চার পার্সেন্ট। বাকিরা রাজনীতি করেন না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তাই সামাজিক শক্তির জাগরণের মধ্য দিয়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।'

পরদিন সকালে সিরাজুল আলম খানের এই ভাবনা নিয়ে আলাপ হয় মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'রাজনীতিবিদরা সিরাজুল আলম খানের কথা শুনতে চাইবেন কেন? ভাবনাটা হিসেবে এগুলো বেশ। কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি গড়ে ওঠার দরকার, তা হচ্ছে না। এ ছাড়া যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাদের তো ভিন্ন ভাবনা, ভিন্ন ধান্ধা রয়েছে।' 'জাসদের উত্থান পতন'সহ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কয়েকটি আলোচিত বইয়ের লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এখন রাজনীতির রহস্যপুরুষ বলে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের জীবনী লেখার কাজ করছেন। তার কাছে এই রহস্যপুরুষের জীবনে কোন সময়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, জানতে চাওয়া হলে বলেন, 'একটা সময় বিশেষ করে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি রাজনীতির একজন বড় অনুঘটক ছিলেন। ৬-দফা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ, এমনকি ছাত্রলীগেরও বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতা যখন জেলে তখন সংগঠনকে চালিয়ে নিয়েছেন সিরাজুল আলম খান। মুক্তিযুদ্ধের পর তার হাতে গড়া জাসদ প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল। তারুণ্যের শক্তিকে তিনি উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন। তাদেরকে এক ধরনের স্বপ্নও দেখাতে পেরেছেন। তিনি কাজটা ভালো করেছেন, না খারাপ করেছেন; ব্যর্থ হয়েছেন, না সফল হয়েছেন- সেটা ইতিহাসের বিবেচ্য।'
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে