রবিবার, ০১ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৫০:৩২

আততায়ীর খুন কি প্রতিকারহীন ?

আততায়ীর খুন কি প্রতিকারহীন ?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা আর তাজিয়া মিছিলের বোমা হামলার বিতর্কের মধ্যেই ফের ঘটলো হত্যাকাণ্ড।এবার নিজ অফিসে খুন হলেন প্রকাশক-বগ্লার ফয়সাল আরেফিন দীপন।একই দিন(৩১ অক্টোবর)লালমাটিয়ায় কার্যালয়ে ঢুকে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়েছে সন্ত্রাসীরা।এভাবে ধারাবাহিক খুনের ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।।কর্মক্ষেত্রে, বাসায় ও রাস্তাঘাটে একের পর এক খুন হচ্ছে। তাহলে মানুষ কোথায় যাবে, কী করবে?এর কি কোনো প্রতিকার নেই? রাষ্ট্র-সমাজের এমন করুণ পরিণতিতে নিহত প্রকাশক দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক ক্ষোভে-দু:খে বলেছেন, ‘হত্যাকারীদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই না। কেননা বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক। বিচার চেয়ে কি হবে? একজনের ফাঁসি দিয়ে কি হবে? না দিলেই বা কি হবে?’ তাঁর এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র আজ কতটা দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। সমাজের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াচ্ছে।তাই বলে কি আমরা সবাই রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতা নীরবে সহ্য করে আততায়ীর হাতে খুন হওয়াকে নিয়তি বলেই মেনে নিবো? না, আমাদেরও কিছু করার আছে। হত্যাকাণ্ডের পর শনিবার রাতে গণমাধ্যমে দেয়া দক্ষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শােনে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছি।কেননা, রাষ্ট্র যে নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এটা কোনোভাবেই মানতে নারাজ।বরং যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে সংঘটিত খুনের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে এখানকার এসব খুনকে স্বাভাবিক হিসেবে বলার চেষ্টা করেছেন তিনি। অন্যদিকে ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেই দিয়েছেন, ‘কেউ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, কেউ জেএমবি, কেউ হরকাতুল জিহাদ, কেউ হুজি নাম দিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করছে। এরা জামায়াত-শিবির বিএনপির খণ্ডিত অংশ।’ দেশের রাজনীতিতে যখন ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়া দ্বন্দ্ব, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যক্তিগত, সামাজিক জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়, অগণতান্ত্রিক চর্চা, সমাজে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, ভিন্ন কায়দায় প্রতিপক্ষ তথা ভিন্নমতের লোকদের অবদমিত করার প্রয়াস তখন দায়িত্বশীলদের এ ধরনের বক্তব্য যেমন নাগরিকদের হতাশ করছে তেমনি খুনিদের উৎসাহিত করবে। গেল ১১ বছরে ১১ ব্লগারসহ আলোচিত ২৫জন খুন হয়েছেন। ব্লগারকে তাদের লেখালেখির কারণে হত্যা করা হয়েছে। এখন শুধু লেখকই নয়, প্রকাশকেরাও হচ্ছেন হামলার শিকার।বিদেশী নাগরিকসহ অন্যান্য পেশার নাগরিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না এ থেকে। কোনও ঘটনারই বিচার হয়নি না। চোখে পড়ার মতো কোনো মামলারই অগ্রগতি নেই।সর্বশেষ গতকাল (৩১ অক্টোবর ২০১৫) দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশকের উপর হামলার ঘটনায় এই প্রশ্নটিই আবারও সামনে উঠে এসেছে।দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেই নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করা হয়। আমরা কি দেখলাম, হামলা ও হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একই কায়দায় এর দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা ভারতীয় শাখা।অভিজিৎসহ অন্য হত্যার তদন্তে পুলিশের পাশাপাশি মার্কিন এফবিআইও এগিয়ে আসলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই।ফলে এই হত্যাকাণ্ড আগের মামলার ব্যর্থতাগুলোই আমাদের সামনে এনে দেয়। আজকের এই হত্যাকাণ্ড দেশব্যাপী নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নটিকে আরো বেশি করে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিদিন হত্যা-খুন আর গুমের শিকার স্বজনদের আহাজারি।এটা যেন কোনোভাবেই থামছে না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?এটা কী কোনোভাবেই থামবে না? আমরা কী সবাই নীরবেই সহ্য করে যাবো এসব হত্যাকাণ্ড? না, এই একবিংশ শতাব্দীতে সভ্য সমাজে এভাবে তা চলতে পারে না, যে কোনো মূল্যে তা থামাতেই হবে- অন্যথায় নিরাপত্তাহীনতার জালে আচ্ছাদিত হবে দেশের মানুষ, ভেঙ্গে পড়তে পারে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো। আর এটা সহজেই বলা যায় যে- এই খুনের মহোৎসব মূলত: বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই। সরকার উদাসীন।গত কয়েক বছরে ওয়াশিকুরসহ ১১ ব্লগার নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন। ইতোপূর্বে ব্লগার হত্যার কোনো ক্লু বের করতে পারেনি পুলিশ। এরপরও কী পুলিশের এই ব্যর্থতার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? না, নেয়নি।বরং যখন যে ক্ষমতায় এসেছে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে।বর্তমানে তো র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তাদের কথা শোনে আক্কেল গুড়ুম।কেননা, তাদের আমলাদের বক্তব্য প্রচলিত রাজনীতিবিদদের বক্তব্যকেও হার মানায়। ফলে শুধু ১১ ব্লগারই নয়, হত্যাকারীরা প্রশ্রয় পেয়ে আরো বেশি শক্তি অর্জন করছে।২০০৪ সাল থেকে প্রকাশ্যে সাংস্কৃতিক, উদারমনা ও মুক্তচিন্তার ব্যক্তি এমন কি ইসলামী ব্যক্তিত্বদের হত্যার অভিযানে নামে খুনিরা। ওই সালে মুক্তমনা লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে খুনের অভিযান শুরু হয়। সর্বশেষ খুন হলেন প্রকাশক ও ব্লগার ফয়সাল আরেফিন দীপন। এ নিয়ে গেল ১১ বছরে ১১ ব্লগারসহ আলোচিত ২৫ জন খুন হয়েছেন। এছাড়া হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন আরো বেশ কয়েক ব্লগার। ব্লগারসহ আলোচিত খুন হওয়া বাকি ২৫ জনের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, যাকে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৩০শে মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে তেজগাঁও এলাকার সড়কে কুপিয়ে, গত ১২ মে, ব্লগার অনন্তকে হত্যা করা হয় সিলেটে। ৭ অগাস্ট হত্যা করা হয় নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে। গেল বছরের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিউল ইসলাম লিলনকে, একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আমবাগান গ্রামের ফ্ল্যাটে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তচিন্তার সমর্থক আশরাফুল ইসলামকে।২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে।২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর আর কে মিশন রোডের বাড়িতে কথিত ‘আধ্যাত্মিক পীর’ ইমাম মাহদীর সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুক ও তার বড় ছেলে সরোয়ার ইসলাম ফারুক, খাদেম মঞ্জুর আলম মঞ্জু, মুরিদ শাহিন, রাসেল ও মুজিবুল সরকারসহ ৬ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ৮ আগস্ট খুলনার খালিশপুরে মুসলিম উম্মাহ সংগঠনের প্রধান ও ধর্মীয় নেতা তৈয়েবুর রহমান ও তার কিশোর ছেলে নাজমুম মনিরকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। একই বছরের ৯ এপ্রিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কবি নজরুল ইসলাম হলে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপকে।১৪ ফেব্রুয়ারি কুপিয়ে ব্লগার জাফর মুন্সিকে হত্যা করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্লগার মামুন হোসেন, ২ মার্চ ব্লগার জগৎ জ্যোতি তালুকদার ও ব্লগার জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবুকে হত্যা করা হয়।১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবীর কালশীর পলাশনগরে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন খুন হন। ২০১০ সালে ঢাকার উত্তরায় মসজিদের ঈমাম, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাশিদুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আর ২০০৬ সালে খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের, ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশে বিনোদপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে হামলার শিকার হন সাংস্কৃতিক, উদারমনা ও মুক্তচিন্তাধারী ড. হুমায়ুন আজাদ। চাপাতি ও কুড়ালের কোপে মারাত্মক আহত ড. হুমায়ুন আজাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখে মারা যান।এছাড়া হামলায় গুরুতর জখম হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন বেশ কয়েকজন ব্লগার। গত ১১ বছরে ২৫জন বুদ্ধিজীবী লেখক ভিন্ন সময়ে ভিন্ন স্থানে খুনের শিকার হলেও সব ঘটনার মোটিভ একই দাবি করে এসব ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ প্রতিটি ঘটনাতেই উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর জড়িত থাকার গন্ধ খুঁজে পেয়েছে। যদিও এখন তা অস্বীকার করছে। কিন্তু কোনো একটি ঘটনার আসল খুনিদের চিহ্নিত কিংবা বিচারের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। আমাদের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ যে, অন্য যে কোনো ঘটনায় নিরীহ মানুষকে হয়রানি, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের অমানবিক নির্যাতনে পুলিশ সর্বদা দক্ষতার পরিচয় দিলেও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়ে আজ তাদের ভূমিকা খুবই প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার’ অপচেষ্টাকে নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে।ব্লগার রাজিব-অভিজিত, ওয়াশিকুর, অনন্ত ও নিলয়ের পথ ধরে চলে গেছেন প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন। আমরা তাদের নিরাপত্তা দিতে পারিনি। তাই সমাজের প্রতিটি সদস্যকেই রুখে দাঁড়াতে হবে সন্ত্রাস, অগণতান্ত্রিক চর্চা ও দুর্নীতি-অনিয়ম।তবেই আশা করা যায় একদিন আমাদের সমাজ এই হত্যার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসবে। বিদেশি নাগরিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের ধারাবাহিক খুনের ঘটনা রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাই প্রমাণ করে।সেই সাথে ক্ষমতায় আসীন সরকারের লোকজনের ভুমিকা, কর্মকাণ্ড কিংবা বক্তব্যও আশাপদ নয়।তারা নিরাপত্তার বিষয়ে নাগরিকদের মনে নতুন কোনো আশা সঞ্চার করতে পারননি।বলা যায়, বিগত দিনের পরিস্থিতি সার্বিকভাবে সরকারের ব্যর্থতাই ফুটে উঠেছে।তাই সরকারের উচিত হবে দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে আপনারা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়া।কেননা, এ পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়া অনিবার্য।নিজেরা ব্যর্থতা স্বীকার করে সরে না দাঁড়ালে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনগণ যে কোনো সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সবশেষে, ফয়সাল আরেফিন দীপন মতো আর যাতে কাউকে এভাবে অকালে জীবন দিতে না হয় সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকার নয়, দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সাথে নিহত ফয়সাল আরেফিন দীপনের শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। লেখক: ব্লগার, গবেষক ও কলামলেখক, ই-মেইল- [email protected] ১ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে