সিদ্দিক আলম দয়াল : ‘বানের পানি হামার বেটির বিয়া হবার দিলো না। নদীর এমন ধার বাহে চাচার একখান ঘর ভাসে নিয়া গেলো। কোনো মতে গরু ছাগল হাঁস-মুরগি সাথে নিয়া নদীর এপার রাস্তাত আসি উঠছি। বিয়াই আসি কলো এ বিয়া হবার নয়।’
চার দিকে পানি আর পানি। ব্রহ্মপুত্র নদীর স্রোত পড়েছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উজানডাংগা গ্রামে। দেখতে দেখতে ৩ ঘণ্টার মধ্যে গোটা গ্রামের মধ্যে অন্তত ৯০টি বাড়ি কোমরপানির নিচে তলিয়ে যায়। এই গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ার আলী। তার মেয়ে সুলতানা পড়েছেন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। আশপাশের গ্রামের কেউ স্কুলে যায় না বলে ঘরে বসে থাকা সুলতানার। গ্রামের মানুষ বলে মেয়ে ডাঙ্গর হয়েছে। তার মানে বড় হয়েছে। তাই নজর পড়ে ঘটক আর গ্রামবাসীর।
সুলতানার মায়ের নাম সুফিয়া খাতুন। এক মেয়ে। তাই আদরে আদরে গদগদ। নিজের সংসারের অবস্থাও খারাপ নয়। ব্রহ্মপুত্র নদের উজানডাংগা গ্রামে বাস করলেও পিতা মনোয়ার আলী দুধের ব্যবসা করেন। জমি-জমাও মোটামুটি। এক ছেলে এক মেয়েসহ ৪ জনের সংসার ভালোই চলে। গ্রামে বিত্তবান হিসেবে নাম ডাকও কম নয় মনোয়ার আলীর।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরুর দুধ সংগ্রহ করে শহরে নিয়ে বিক্রি করেন। তাতে লাভও ভালো। বাড়িতে চৌচালা ২টি টিনের ঘর জমি, গবাদী পশু হাঁস-মুরগি সবই। ছেলে রাজা মিয়া ছোট হলেও বোন সুলতানা চরাঞ্চলের ডাঙ্গর(বড়) হয়েছে বলে সবাই বলাবলি করেন।
ঘটকও বিয়ের জন্য টানাটানি করে। তিনমাস ধরে দেখা দেখি। তার বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করা হয়। বর পার্শ্ববর্তী চর নিশ্চিন্তপুরের। হবু জামাইয়ের নৌকা পারাপারের ব্যবসা। মন্দ নয়। পয়সা পাতিও ভালো। মেয়েকে তুলে দিলে জামাই মেয়ে সুখেই থাকবে। তাই গেল বন্যার সময় বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়। পাত্র ও পাত্রী পক্ষের মতামত নিয়ে দিন তারিখ ঠিক করা হলেও প্রথম বন্যার কারণে তাদের বিয়ের দিন পিছিয়ে করা হয় ১৪ই আগস্ট। কথা অনুযায়ী কাজ।
মেয়ের বিয়ে হবে ধুমধামের মধ্য দিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে দূর দুরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনরা আসেন মনোয়ার আলীর বাড়িতে। ঘর ভরা স্বজন আর খাওয়া দাওয়া। বিয়ের প্রস্তুতি হিসেবে মেয়ের পিতা মনোয়ার আলী বর পক্ষের সন্তুষ্ট করতে এ অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার পিটালী, গরুর মাংস ও ঝাল মুরগি ইত্যাদির আয়োজন করতে থাকে। ১২ই আগস্ট বিয়ের চূড়ান্ত কেনা কাটা ও খাবারের সব আয়োজন করা শেষ হয়।
ওইদিন সকাল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর ব্যাপক হারে পানি বৃদ্ধি শুরু হয়। দেখতে দেখতে উজানডাংগা গ্রামে পানি ঢুকে পড়ে। কোনো বাড়িতে হাঁটু ও কোনো বাড়ি কোমর পানির নিচে তলিয়ে যায়। বন্যার পানির কথা ভেবে ৪টি নৌকা রাখা হয় বাড়ির চারপাশে। দরকার হলে নৌকায় বিয়ে হবে। তারপর নৌকায় বাসর। কিন্তু শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে পানির গতি আরো বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে স্রোত।
বাধ্য হয়ে রাতেই গবাদী পশুসহ গ্রামের লোকজন ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকে। গ্রাম ছেড়ে চলে যায় লোকজন। এর মধ্যে চরনিশ্চিন্তপুর থেকে পাত্রপক্ষ ও ঘটক ইসমাইল আসেন মেয়ের পিতা মনোয়ার আলীর কাছে। তারা জানিয়ে দেন এ বিয়ে হবে না। বন্যার কারণে দুই বার বিয়ে ভেঙে যাওয়া তাদের কাছে মেয়ে অলক্ষ্মী হিসেবে বিয়ে ভেঙে দেন। বিয়ে না হওয়ার কারণে গতকাল দুপুরে তারা ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ির সামনে বিয়ের নৌকায় বসে কান্নাকাটি করছিলেন।
নৌকাচালক সাত্তার মিয়া বলেন, কোন দোষে চেংড়িটার বিয়া হলো না। বিয়া ভাঙ্গি গেলো বানের পানির কারণে। আর বিয়ের সরঞ্জাম নৌকায় রেখে কাঁদছিলেন মেয়েসহ মা সুফিয়া বেগম। মা সুফিয়া বলেন, বাবা হামার এতো সুন্দর বেটির বিয়া হলো না বাবা। বানের পানি হামার বেটির বিয়া ভাঙ্গি দিলো। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস