মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭, ০৩:৩১:৫১

শেখ হাসিনা- শেখ রেহানার কান্নায় সেদিন ভেঙে যায় সকল নিস্তব্ধতা

শেখ হাসিনা- শেখ রেহানার কান্নায় সেদিন ভেঙে যায় সকল নিস্তব্ধতা

মেহেদী হাসান : পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার কন্যাদ্বয়ের আশ্রয়দাতা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার স্মৃতিচারণে ওই সময়কার বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন তথ্য দিয়েছেন।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল’ নামক বইয়ে তার এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি ছাপা হয়।

বাবার মৃত্যুর সময় দুই বোন ছিলেন বেলজিয়ামে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সানাউল হক আর তাদের রাখতে চাচ্ছিলেন না বলে জানিয়েছেন ওই সময়ে জার্মানিতে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ খান।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সানাউল হক যখন তাকে ফোন করেন তখন সানাউল হককে বেশ অস্থির মনে হচ্ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি লিখেন, হাসিনা-রেহানাকে নিয়ে যেন খুব ঝামেলায় আছেন। ওদের তাড়িয়ে দিলেই বাঁচেন মনে হলো। বললেন, জানো হুমায়ুন, প্যারিস থেকে আবুল ফতেহ গাড়ি পাঠায়নি। কথা ছিল গাড়ি পাঠাবে, ওদের নিয়ে যাবে। এখনও গাড়ি আসেনি। ফতেহকে পাওয়া যায়নি। ওর বাসায় কেউ টেলিফোন ধরছে না। প্যারিসে শফি সামিকে টেলিফোন করলাম। শফি তখন অসুস্থ, হাসপাতালে। শফিকে বললাম, রাষ্ট্রদূত ফতেহকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেখ সাহেবের মেয়ে আসার কথা প্যারিসে। ওরা যদি আসে, ওদেরকে আদর যত্ন কর। ও বলল, ঠিক আছে। আমার বাড়িতে রাখব। শফির স্ত্রী আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আবার ফোন করলাম ব্রাসেলসে। সানাউল হককে বললাম, ওদের গাড়ি দিয়ে জার্মান সীমান্তে অন্তত পৌঁছে দেন। সানাউল হক রাজি হলেন না। বিস্মিত হলাম। কি বলছেন আপনি। এইটুকু মানবতাবোধও নেই। অথচ শেখ সাহেব তাকে খুব স্নেহ করতেন। ক্ষুদ্ধ হলাম। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই ভদ্রলোক কী এমন আচরণ করতে পারতেন? বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের গাড়ি দিতে রাজি নন। বাড়িতে ঠাঁই দেয়া দূরের কথা। কী বলব, এই ভদ্রলোকই পরবর্তীতে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। যাকগে ওসব কথা। সানাউল হককে বললাম, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। ওরা আমার জার্মানির বাড়িতে আসবে। আমি তাদের আশ্রয় দেব।

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যখন জার্মানিতে পৌঁছান ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেন, শেখ সাহেবের মেয়েরা যখন আমার বাসায় পৌঁছল তখন কী দৃশ্য! ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। জীবনে অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। এমন হইনি কখনো। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। হিমশীতল পরিবেশ।

তিনি আরও লিখেন, হাসিনা-রেহানা জানত না- ঢাকায় শেখ পরিবারের সবাই মারা গেছেন। তাদের সব কিছু জানানো হয়নি। আমার বাসায় তিনটি রেডিও ছিল! একটি রেডিও ছাড়া বাকি দুটি আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখে দিলাম। কীভাবে যেন হাসিনা-রেহানা জেনে গেল, শেখ সাহেব মারা গেছেন। এই খবর শোনামাত্র ড. ওয়াজেদ বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমার মনে আছে, শেখ হাসিনা আমায় বলেছিল, জানি জানি কামাল-জামালও চলে গেছে।

বইটিতে তিনি লিখেন, হাসিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিল, চাচা আমার মা ও রাসেলকে আমাদের কাছে আনার ব্যবস্থা করুন। রাত তখন দশটা। আমি জানতাম বেগম মুজিব মারা গেছেন। তবু আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি দেখছি কী করা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তারা কীভাবে যেন নিশ্চিত হয়ে গেল- বেগম মুজিবও নেই। কী বলব ওদের অবস্থার কথা। হাসিনার অনুরোধেই আমি টেলিগ্রাম পাঠালাম ঢাকায়, শেখ রাসেলকে যেন জার্মানি পাঠানো হয়। আমার ধারণার বাইরে ছিল, এই অল্প বয়সের শিশুটিকেও হত্যা করা হয়েছে।

তবে খন্দকার মোশতাক এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এ কথা শেখ হাসিনা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলেন না বলে উল্লেখ করে তিনি লিখেন, আমি বললাম, রেডিও রিপোর্ট থেকে শুনেছি খন্দকার মোশতাকের কথা। হাসিনা কোনোমতেই বিশ্বাস করতে রাজি নয়। আব্বার সঙ্গে মোশতাক চাচা কত ঘনিষ্ঠ। পরিবারের একজন সদস্যের মতো। তিনি এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন না। হাসিনা অবিশ্বাস করলে কী হবে, মোশতাকই এ ঘটনার নায়ক। অভ্যুত্থানের সুবাদে প্রেসিডেন্ট।

বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ায় কিছু ব্যক্তি হুমায়ুন রশীদের উপর চটে যান বলে উল্লেখ করে তিনি লিখেন, এই যখন অবস্থা, তখন জার্মান প্রবাসী কিছু বাংলাদেশি যুবক এসে ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। তারা বলল, আমি কেন শেখ সাহেবের মেয়েদের ঠাঁই দিয়েছি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন তাদের বাসা থেকে বের করে দেই। তা না হলে আমাকে তারা দেখে নেবে। তারা কয়েকটি পাসপোর্ট বের করে বলল- তাতে যেন ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সিল মেরে দেই। তাদের ধারণা বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র হয়ে গেছে।

হুমায়ুন রশীদের বাসায় থাকা অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে তাদের জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে জানিয়ে তিনি লিখেন, আমার এক ভাগিনা এসে হাজির। সুঠাম দেহের অধিকারী ভাগিনা যখন তার কক্ষে যাচ্ছিল, তখন শেখ সাহেবের এক মেয়ে তাকে দেখে ফেলে। তারা ভাবে অন্য কেউ হয়তো এসেছে, তাদেরকে হত্যা করতে। সারা রাত তারা ঘুমায়নি।

ড. ওয়াজেদ সোভিয়েত ইউনিয়নে আশ্রয় চাওয়ার চিন্তা করছিলেন বলে জানিয়ে তিনি লিখেন, ড. ওয়াজেদ আমাকে জার্মানস্থ সোভিয়েত দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ রাখার অনুরোধ জানালেন। তার ধারণা ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে আশ্রয় দেবে। আমি জানালাম, আশ্রয় নিতে চাইলে সোভিয়েত কেন জার্মানিতেই হবে। এটা কোনো সমস্যা নয়। ইচ্ছা করলে লন্ডনেও যাওয়া যেতে পারে।

‘একসময় ভারতীয় হাই কমিশনার মি. রহমান টেলিফোন করে শেখ পরিবারের সদস্যদের কুশলাদি জানলেন। বললাম, তারা ভালো আছে, আমি দেখাশোনা করছি। তিনি বললেন, মিসেস গান্ধী খুব খুশি হয়েছেন আমি আশ্রয় দিয়েছি জেনে। হাসিনাকে বললাম, ভারতীয় হাইকমিশনার মি. রহমান দেখা করতে চান তার সঙ্গে। সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো। আমি গরহাজির থাকলাম। ড. ওয়াজেদ সবাইকে নিয়ে গেলেন কার্লশোতে। সেখানে শিক্ষা সফরে এসেছিলেন তিনি। কিছুদিন পর ভারতীয় হাইকমিশনার জানালেন, শেখ পরিবারের সদস্যগণ নিরাপদে, সুস্থভাবে বসবাস করছেন দিল্লিতে’ লিখেন তিনি।

তবে এ ঘটনায় হুমায়ুন রশীদের ওপর খন্দকার মোশতাক বেশ রেগেছিলেন বলে উল্লেখ করে ওই বইতে তিনি লিখেন, ২৫ আগস্ট জেনেভা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী টেলিফোনে জানালেন, মোশতাক সাহেব খুবই ক্ষিপ্ত। কেন আমি হাসিনা-রেহানাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। আবু সাঈদ বললেন, প্লিজ, আপনি ঢাকা যাবেন না। গেলে বিপদ হবে। দু’দিন পর ঢাকা থেকে বার্তা, আমাকে ওএসডি করা হয়েছে। সূত্র-প্রিয়.কম
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে