বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:৩৮:৩০

ভয়াল রূপ নিচ্ছে বন্যা, এখন ২৮ জেলা জুড়ে বিস্তার

ভয়াল রূপ নিচ্ছে বন্যা, এখন ২৮ জেলা জুড়ে বিস্তার

নিউজ ডেস্ক : দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ভয়াল রূপ নিচ্ছে বন্যা। পানি বাড়তে শুরু করেছে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতেও। দ্বিতীয় দফার বন্যায় গত ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-উত্তরপূর্ব ২০ জেলার বিভিন্ন উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে মধ্যাঞ্চলের আট জেলায় বিস্তৃত হয়েছে বন্যা। উত্তর-উত্তরপূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের মোট ২৮ জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। গত চার দিনে বন্যায় শিশু ও নারীসহ ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২০ জন বলা হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবারই দিনাজপুর, রংপুর ও গাইবান্ধায় মৃত্যু হয়েছে চারজনের। রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পাঁচ জেলার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বেশ কয়েকটি এলাকার সঙ্গে বন্ধ হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগও। উত্তরাঞ্চলে অন্তত ২৩টি স্থানে বন্যা রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে।

মধ্য জুলাই থেকে উত্তরের জেলাগুলো বন্যাকবলিত হতে শুরু করে।
এরই মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চলেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করেছে। ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ীর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পদ্মার পানি বাড়তে থাকায় মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) তিন বছর আগেই পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিল, বর্ষা মৌসুমে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা (জিবিএম) অংশে বৃষ্টির ধরনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসবে। এতে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে। দুই বছর আগে বিশ্বব্যাংক আলাদা একটি গবেষণায় দেখিয়েছিল, রাজধানীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে।

আগে যেমন দিনে ৫০ থেকে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতো, আগামী দিনগুলোতে সেটি বেড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্তও উঠতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ওই গবেষণায় আরো বলা হয়েছিল, যমুনা নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বাড়লে এর প্রভাব আসবে রাজধানী ঢাকায়।

এবারের বর্ষা মৌসুমের শুরুতে অতিবৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ দেখে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, মধ্য আগস্টে বড় ধরনের বন্যার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে দেশ। জাতিসংঘের আইপিসিসি, বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র—তিনটি সংস্থার পূর্বাভাসই সত্য প্রমাণিত হলো।

শুধু বাংলাদেশই নয়, বড় ধরনের বন্যার মধ্যে পড়েছে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও। ওই সব দেশেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ভারতের আবহাওয়াবিষয়ক রাষ্ট্রীয় সংস্থা আইএমডির চলতি সপ্তাহের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশটির পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, অরুণাচল ও সিকিম রাজ্যে টানা ভারি বৃষ্টি হবে।

এরই মধ্যে ওই রাজ্যগুলোর বিস্তৃত এলাকা তলিয়ে গেছে। রাজ্যগুলো দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতের ওই সব রাজ্যে ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে তা বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে বলে বাংলাদেশের বন্যা ও নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে চলতি সপ্তাহ নাগাদ। অতিবৃষ্টির পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে বন্যা এত দিন উত্তরাঞ্চলজুড়ে থাকলেও রাজধানী ঢাকাও বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছে। এমন আভাসই মিলেছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হালনাগাদ তথ্যে।

ঢাকার চারপাশ ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা বালু ও তুরাগ এই চারটি নদ-নদীতে গতকাল বিকেল পর্যন্ত পানির প্রবাহ বেড়েছে। ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে এই চারটি নদীতে ১০ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি বেড়েছে। অবশ্য বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার চারপাশে চারটি নদীর পানি বাড়লেও এখনো বিপত্সীমার অনেক নিচে পানি আছে। আগামী তিন দিন ঢাকায় পানি ঢুকবে না এটা বলা যায়। তিনি বলেন, যমুনার পানি বাড়লে সে ক্ষেত্রে রাজধানীতে পানি উঠতে পারে।

তথ্য বলছে, ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম স্টেশনে গতকাল বিপত্সীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি বইছে। এ ছাড়া বদরগঞ্জে বিপত্সীমার ১৪২ সেন্টিমিটার, জারিয়াজঞ্জাল পয়েন্টে ১৬২ সেন্টিমিটার, কাজীপুর পয়েন্টে ১৩৫ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি বইছে। ৯০ পয়েন্টের সব পয়েন্টেই বিপত্সীমার ওপর দিয়ে পানি বইছে।

আবহাওয়া কর্মকর্তা আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘এ বছর বৃষ্টিপাত অন্যবারের তুলনায় বেশি হচ্ছে। আবহাওয়া বিচিত্র আচরণ করছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলাতেই। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। তাই সেখানে পাহাড়ধসের শঙ্কা রয়েছে। ’

জানতে চাইলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘অন্যবারের তুলনায় এ বছর বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সে কারণে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ’

অধ্যাপক আইনুন নিশাত আরো বলেন, ‘যমুনার পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে রাজধানীতে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাশ ততটা সংরক্ষিত নয়। ফলে বন্যার কারণে রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে বিপদ হতে পারে। তবে পশ্চিমাঞ্চল বেশ সুরক্ষিত হওয়ায় সেখানে ক্ষয়ক্ষতি হবে না। শেরপুর, জামালপুরসহ উত্তরাঞ্চলে বন্যার পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। ’

চার দিনে ৩৬ জনের মৃত্যু : বন্যার পানিতে ডুবে গত চার দিনে নারী-শিশুসহ ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শনি ও রবিবার তিন জেলায় বন্যায় ডুবে শিশুসহ ২০ জনের মৃত্যু হয়। সোমবার তিন জেলায় পাঁচ শিশুসহ মৃত্যু হয় ১২ জনের। গতকাল তিন জেলায় শিশু, নারীসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে দিনাজপুরে ১৬ জন; এর পরই রয়েছে কুড়িগ্রামে ১৩ জন ও লালমনিরহাটে পাঁচজন।

গতকাল দুপুরে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম আতাবুর (৫০)। জানা যায়, বাড়ির পাশের তিলাই নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন তিনি। রংপুর বদরগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে মাসুম মিয়া নামে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে কালুপাড়া ইউনিয়নের দাঁড়িয়ারপাড় ব্রিজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পানিতে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কায় নিজ বাড়ি থেকে নানার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল তাকে। গাইবান্ধার ফুলছড়ির জিগাবাড়ী গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে হানিফ মিয়া (৫) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কুড়িগ্রামে রাজারহাটের কালুয়ার চরে ফাতেমা নামের একজন নিখোঁজ গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

উত্তরাঞ্চলে ২৩ স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবন : উত্তরাঞ্চলে এবারের বন্যায় প্রায় ২৩ স্থানে বন্যা রক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবনের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় ৯টি বাঁধ ভেঙে যায়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ী, রাজারহাটের কালুয়া ও ফুলবাড়ীর গোড়কমণ্ডল এলাকায় বাঁধ ভেঙে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের রাজবল্লভ এলাকায় তিস্তা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ৬০ ফুট অংশ ভেঙে গেছে।

নওগাঁর মান্দা উপজেলায় গতকাল আত্রাই নদের আটটি স্থানে বাঁধ ভেঙে আটটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নওগাঁ শহর রক্ষা বাঁধ উপচে এবং পৌরসভার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধায় পানির চাপে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অসংখ্য স্থান ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। বাঁধ সুরক্ষায় সহযোগিতা করতে কাজ করছে সেনাবাহিনী। বগুড়ার ধুনট উপজেলায় চন্দনবাইশা এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

সড়ক ও রেলপথ, বিমানবন্দর আক্রান্ত : বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরের দক্ষিণ অংশে দেয়াল ভেঙে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। তবে রানওয়েতে এখনো পানি না ওঠায় বিমান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

বন্যার পানির তোড়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ-পঞ্চনন্দ সড়কের পঞ্চনন্দ এলাকায় ১০০ মিটার অংশ ভেঙে যাওয়ায় ওই এলাকার সঙ্গে উপজেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জয়পুরহাটে জয়পুরহাট-বগুড়া সড়কের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকা ও কোমর গ্রাম সড়কের ওপর দিয়ে পানি বইছে।

সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের অন্তত সাতটি স্থান প্লাবিত হওয়ায় সুনামগঞ্জ শহরের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে।

লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি, দুর্ভোগ : উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সড়কের ধারে বা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে দুর্গতরা। সরকারি হিসাবে উত্তরাঞ্চলে এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ২৮ হাজার ৭৬৯। ২০টি জেলার ৫৬টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ৫৬২টি আশ্রয়কেন্দ্রে চার হাজার ৯৫০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তবে কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধিদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুড়িগ্রামেই প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি।

সিরাজগঞ্জ সদর, শাহজাদপুর, চৌহালী, কাজীপুর উপজেলার চরাঞ্চলের ৮০ শতাংশ এলাকা বন্যাকবলিত। রংপুরের ছয় উপজেলার ৩০ ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি। লালমনিরহাটে এক লাখ দুই হাজার ৭৫০টি পরিবার বন্যাকবলিত।

নওগাঁর মান্দা উপজেলায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পঞ্চগড়ে পাঁচ উপজেলায় অর্ধলক্ষের বেশি পরিবার বন্যাকবলিত। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি।

উত্তরে বন্যার আরো অবনতি : উত্তরাঞ্চলের ২০ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কুড়িগ্রামের পানি বৃদ্ধি ও বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলায় আরো ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।

টগরাইহাটের বড়পুলের পাড় এলাকায় রেলওয়ের একটি ব্রিজের গার্ডার ধসে পড়ায় রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। রাজীবপুর উপজেলা চত্বরসহ হাটবাজার বন্যার পানিতে ভাসছে। গতকাল সকালে বাঁধ ভেঙে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধার সব নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পলাশবাড়ীর চেরেঙ্গা এলাকায় করতোয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০০ মিটার অংশ গতকাল ভেঙে যাওয়ায় আটটি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পার্বতীপুরের আমবাড়ী থেকে দিনাজপুরের পাঁচবাড়ী পর্যন্ত মহাসড়কে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় চলাচল বন্ধ রয়েছে। জয়পুরহাটে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর আমন ফসল পানিতে ডুবে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

ডুবে যাওয়ায় জয়পুরহাট-বগুড়া সড়কের তিনটি অংশের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বগুড়ায় সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার অন্তত ১০টি পয়েন্টে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়ে পানি চুয়ে ভেতরের অংশে প্রবেশ করছে। এতে এসব এলাকার লোকজন ব্যাপক আতঙ্কের মধ্যে পড়েছে।

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জামালপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরীণ সব সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

নওগাঁর জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের বাসভবন, জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, বিহারি কলোনি, নাপিতপাড়া, উকিলপাড়া, কালীতলা, পার-নওগাঁসহ শহরের বিভিন্ন স্থান এক থেকে দেড় ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি বিপত্সীমার নিচে নামলেও বিভিন্ন বাঁধ ও সড়ক বিধ্বস্ত হওয়ায় বসতবাড়িতে প্রবেশ করা পানি কমছে না। ফলে উঁচু স্থানে আশ্রিতরা ঘরে ফিরতে পারছে না।

মধ্যাঞ্চলের আট জেলায় বিস্তৃত হয়েছে বন্যা : ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ীর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পদ্মার পানি বাড়তে থাকায় মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। গতকাল ফরিদপুরে বেড়িবাঁধ ভেঙে পদ্মার পানি ঢুকে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি ও আদালত ভবনে পানি উঠেছে এবং ৫৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, সোমবার গোয়ালন্দ, ভাগ্যকূল ও সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপত্সীমার যথাক্রমে ১০০, ৬০ ও ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

গত ২৪ ঘণ্টায় গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার হ্রাস পেলেও ভাগ্যকূল ও সুরেশ্বর পয়েন্টে এ নদীর পানি যথাক্রমে ২ ও ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। স্বাভাবিক বন্যায় দেশের ২০-২৫ শতাংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলেও এবার এরই মধ্যে ৩০ শতাংশের মতো এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

মানিকগঞ্জের আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ সেন্টিমিটার। জেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ধলেশ্বরী, ইছামতি, কালিগঙ্গাতেও দ্রুত পানি বাড়ছে। জেলার শিবালয়, দৌলতপুর, হরিরামপুর ও ঘিওর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

এসব এলাকার অনেকেই অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। কালীগঙ্গা নদীর তীব্র স্রোতে ভেঙে গেছে সাটুরিয়া উপজেলার পশ্চিম চরতিল্লী গ্রামের দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধ। স্থানীয়দের উদ্যোগে ভাঙা অংশে ফেলা হচ্ছে বালুর বস্তা।

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাজবাড়ীতে হু হু করে বাড়ছে পদ্মা নদীর পানি। গতকাল জেলার তিনটি পয়েন্টের মধ্যে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় পদ্মা নদীর পানি বিপত্সীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং পাংশা উপজেলার সেনগ্রাম তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মহেন্দ্রপুর পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

ত্রাণ তৎপরতা ও হাহাকার : উত্তরাঞ্চলে লাখ লাখ বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে জানিয়েছে দুর্গতরা। বন্যার্তদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।

সরকারের নির্দেশে উত্তরাঞ্চলে বন্যার্তদের সাহায্যে সেনা মোতায়েন রয়েছে। নতুনভাবে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে প্রয়োজনীয় স্পিডবোট ও উদ্ধারসামগ্রীসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও সৈয়দপুরে সেনা সদস্য ও উদ্ধার সরঞ্জাম বাড়ানো হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় সেনাবাহিনীর ২৮ প্লাটুন সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ত্রাণ হিসেবে ২৪২ মেট্রিক টন চাল ও আট লাখ টাকা বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণের কাজ চলছে। নওগাঁ জেলা প্রশাসক ড. আমিনুর রহমান ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। দিনাজপুর জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোকলেচুর রহমান জানান, গতকাল পর্যন্ত ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা উপজেলা প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস
 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে