শুভ্র দেব : সোমবার সন্ধ্যা। ছেলের মোবাইল থেকে কল আসে বাবা আনোয়ার হোসেনের কাছে। ভীত কণ্ঠে বলে, সন্ত্রাসীরা আমাকে ধরেছে। তিন ঘণ্টার মধ্যে এক লাখ টাকা পাঠাও। না হলে আমাকে মেরে ফেলবে।’ আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে ছেলে বিজয়ের এটাই শেষ কথা। কথা শেষ না হতেই মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এরপর থেকে অনেকবার ছেলের মোবাইল ফোনে কল দিয়েছেন আনোয়ার হোসেন। কিন্তু সেটি বন্ধ পেয়েছেন। তারপর থেকেই উদ্বিগ্ন বিজয়ের পরিবার। অবশেষে মঙ্গলবার রাতে সন্ধান মেলে বিজয়ের। তবে জীবিত না, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সন্ধান মেলে তার লাশের। আল আমিন মাহমুদ বিজয় ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সোমবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি।
এ ব্যাপারে শাহজাহানপুর থানায় ওইদিন একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের পেছনের একটি ভবন থেকে তার হাত-পা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত বিজয়ের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুরের দেবনগর গ্রামে। মালিবাগের ১ম লেনের ১৩১/১ নম্বরের একটি বাসার মেসে থাকতেন তিনি। বাবা আনোয়ার হোসেন গ্রামে কৃষি কাজ করেন। বিজয়ের সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন ইব্রাহিম খলিল ও তানভির স্মরণ নামে তার দুই বন্ধু।
তারা জানায়, বিজয় দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে অসুস্থ হয়ে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। গত রোববার তিনি ঢাকায় আসেন। রোববার সারারাত বন্ধুদের আড্ডা সঙ্গে দেয়। পরদিন সকাল ১১টায় মালিবাগের ইবনে সিনা হাসপাতালে যায়। সেখানে চিকিৎসক দেখান। এরপর দুপুরে তার এক দূর-সম্পর্কের মামা রিপন মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফেরেন। পরে বিকাল ৪টার দিকে বিজয় তার মামা রিপনকে এগিয়ে দেয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। এরপর আর বাসায় ফিরে আসেননি।
মেসের আরেক বাসিন্দা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন জানান, বিজয় ও তার গ্রাম একই। দীর্ঘদিন ধরে তারা একই সঙ্গে মেসে থাকেন। সোমবার সন্ধ্যার পর তার মোবাইলে বিজয়ের ভাবি পরিচয়ে এক নারী ফোন দেন। ফোন দিয়ে বিজয় দুর্ঘটনায় পড়েছে বলে জানান। জসিম উদ্দিন বিস্তারিত জানতে চাইলে ওই নারী পরে বলবেন জানিয়ে ফোন রেখে দেন। এর কিছুক্ষণ পর জসিমের মোবাইলে বিজয়ের বাবার ফোন আসে।
বিজয়ের বাবা ফোন দিয়ে জসিমকে বলেন, বিজয় তার নিজ মোবাইল থেকে ফোন দিয়ে বলেছে তাকে সন্ত্রাসীরা ধরেছে। তিন ঘণ্টার মধ্যে এক লাখ টাকা পাঠাতে হবে। এখন তিনি কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। পরে বিজয়ের বাবা জসিমকে থানায় একটি জিডি করার কথা বলেন। জসিম মেসের আরো তিন সদস্য নিয়ে শাহজাহানপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরদিন মঙ্গলবার বিজয়ের বাবার মোবাইলে অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোন আসে।
ওই সময় বলা হয়, তোকে না বলছিলাম টাকা পাঠানোর জন্য, পাঠাইস নাই কেন? এই বলে মোবাইল বন্ধ করে দেয়। বিজয়ের বাবা বন্ধ মোবাইলের বিকাশ একাউন্টে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ২০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তারপরও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি তার।
জসিম উদ্দিন আরো জানান, মঙ্গলবার রাতে শাহজানপুর থানার উপপরিদর্শক কুমার দাস তার মোবাইলে ফোন দিয়ে জানান, মিরপুর থানা পুলিশ একটি ছেলের লাশ উদ্ধার করেছে। তাকে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। পরে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে বিজয়ের লাশ সনাক্ত করেন। এদিকে বিজয় হত্যার খবর পেয়ে তার পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
পাঁচ মেয়ের মধ্যে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বিজয়ের বাবা-মা শোকে কাতর হয়ে গেছেন। এদিকে বিজয় সোমবার বিকালে রিপন নামে তার যে মামার সঙ্গে বেরিয়েছিলেন বিজয় নিখোঁজের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। অপরদিকে, শাহজাহানপুর থানায় জিডির পর পুলিশ তার নাম্বার ট্রাক করে জানতে পেরেছিলেন বিজয়ের অবস্থান মিরপুরে।
উল্লেখ্য, বড়বাগের ৩৭/১ বাসাটিতে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসারত রোগীদের স্বজনরা দিন চুক্তিতে ভাড়া থাকেন। সেই ভবনের দ্বিতীয় তলার ২০৩ নম্বর কক্ষটিতে অন্য তালা দিয়ে বন্ধ রয়েছে দেখে ভবনের মালিক পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ তালা ভেঙে বিছানার নিচ থেকে বিজয়ের লাশ উদ্ধার করে। মিরপুর থানার পুলিশের উপপরিদর্শক অজিত রায় জানান, নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি