সোমবার, ০২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৪৫:৪৮

সরকার ও দলে অস্বস্তি বাড়ছে

সরকার ও দলে অস্বস্তি বাড়ছে

বিশেষ প্রতিনিধি : একের পর এক হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কোত্থেকে করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে সরকার অন্ধকারে রয়েছে। এসব ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সরকার ধারণা করছে। তবে এই ধারণা প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। এসব ঘটনার পেছনে যে ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত আছে, সে সম্পর্কে সরকার নিঃসন্দেহ। কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলো কারা, কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে; তাদের ঘাঁটি কিংবা বিচরণক্ষেত্র কোথায়; পারস্পরিক যোগাযোগের কৌশল কী, কোত্থেকে এসে একেকটি ঘটনা ঘটিয়ে কোথায় তারা যায়, এর কোনো কিছুই সরকার জানে না। এ কারণে সরকার এসব হামলা ও হত্যাকাণ্ডের কিনারাও করতে পারছে না। প্রতিহত করার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে। একই সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় সরকার সম্পর্কে জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হয় কি না, সেই ভাবনাও আছে সরকারের নীতিনির্ধারক ও দলীয় নেতাদের মধ্যে। গত শনিবারের দুটি হামলা-হত্যাকাণ্ডের পর গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিশেষ ব্যস্ততা লক্ষ করা গেছে। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে একধরনের গুমোট ভাব বিরাজ করছিল বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে। গত রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের এক বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকের পর গণভবনে জাতীয় গোয়েন্দা সমন্বয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানেরা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আজ সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেল হত্যা দিবসের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে গতকাল সচিবালয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব পর্যায়েই আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল শনিবারের হামলা। বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যেই উদ্বেগ লক্ষ করা গেছে। স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি। জানা থাকলে তা প্রতিহত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেত। অজানা কিংবা ভাসা ভাসাভাবে জেনে এসব ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনো ইতিবাচক কোনো তথ্য আসেনি। তবে অনুরোধ করব, যাঁরা এ হুমকি পাচ্ছেন তাঁদের বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগাতে।’ দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো অবনতি হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আনসারুল্লাহ, জেএমবি বা আইএস—যারা এটা করুক না কেন, তারা যুদ্ধাপরাধী বা জামায়াত-শিবিরের লোক। কয়েকজন মন্ত্রী ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিরোধী দলের সন্ত্রাসী আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ সাফল্য দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার বেশ শক্তিশালী এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম—এমন একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দুই বিদেশি হত্যা ও নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশক-ব্লগারদের ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। কিন্তু কেন হামলা ও হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যাচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। তবে এটা ঠিক, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি রুদ্ধ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, হামলাকারী-হত্যাকারীদের আইনের মুখোমুখি করা হবে এবং জঙ্গিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি মুক্তচিন্তার নামে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বিরুদ্ধেও ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি দেখাবে। সরকার মনে করে, মুক্তচিন্তার নামে ব্লগারদের লাগামহীন লেখার কারণে দেশে সামাজিক ও ধর্মীয় অস্থিরতা তৈরির উপক্রম হয়েছে। আওয়ামী লীগের একজন মধ্যম সারির নেতা বলেন, বিরোধীদের দমনে সাফল্য পাওয়ার পর সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাদের অনেক সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই সব করছে—এই ধারণার ফলে দলের কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে সাধারণ মানুষ ও তৃণমূল নেতাদের মধ্যে অল্পতেই অস্থিরতা ও আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, গত শনিবার বিকেল থেকে দলের তৃণমূল ও নিচের সারির অনেক নেতা-কর্মী ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা জানার চেষ্টা করছেন। অনেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি একটা অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে জনমনে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সরকার অতীতেও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরকার এসব ঘটনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। প্রতিরোধের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর আছে। একাধিক মন্ত্রী ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার প্রকাশক-ব্লগারদের ওপর হামলার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জ্যেষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রীদের সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা না হওয়ায় তারা বিষয়টি সম্পর্কে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতেও দ্বিধাগ্রস্ত। আহত ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়ার বিষয়েও অনেকের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করেছে। একজন নেতা বলেন, এই পরিস্থিতিতে নেতা-মন্ত্রীরা যে হামলার শিকার হবেন না এর নিশ্চয়তা কী? আরেক নেতা বলেন, আহত ব্যক্তিদের দেখতে গেলে তাদের স্বজন ও সাধারণ মানুষ কেমন আচরণ করবে তাও একটা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে কোনো কোনো নেতা আহত ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেও শেষ পর্যন্ত যাননি। -প্রথম আলো ২ নভেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে