বৃহস্পতিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:১৭:১৫

প্রাণ বাঁচাতে মরছে রোহিঙ্গারা

প্রাণ বাঁচাতে মরছে রোহিঙ্গারা

মহিউদ্দিন অদুল, উখিয়ার কুতুপালং থেকে : শুধু হত্যা বা গণহত্যা নয়। প্রাণ বাঁচাতে গিয়েও প্রাণ হারাচ্ছে বহু রোহিঙ্গা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথে বাংলাদেশে আসার পথে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। অনাহার-অর্ধাহারে রাত-দিন দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে তারা। সাগর-নদীতে ডুবে মারা যাচ্ছে।

ক্ষুধা ও অসুস্থতায় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হচ্ছে কারও কারও। আহত ও গুলিবিদ্ধদের প্রাণহানি তো রয়েছেই। এমন করুণ পরিণতি নিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছার পরও খাদ্য-পানি এবং চিকিৎসার অভাবে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে একের পর এক রোহিঙ্গা। অপুষ্টি ও ক্ষুধায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার ধকল সইতে না পেরে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে শিশুরা।

জঙ্গলে অখাদ্য ও দূষিত পানি খেয়ে ডায়রিয়া ও জ্বরে ভুগছে অনেকেই। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা ও খাবার না পেলে বাংলাদেশে পৌঁছা রোহিঙ্গারা আরো অমানবিক পরিস্থিতিতে পড়বে বলে মনে করছেন সাময়িক ত্রাণ কার্যক্রম সংশ্লিষ্টরা।

মংডুর বলিবাজার লংদু এলাকার চিনগিরি পাড়ার খুইল্লা মিয়া ও তার স্ত্রী আছিয়া বেগমসহ একাধিক পাড়ার অন্তত ৬ হাজার মানুষ গত ২৮শে আগস্ট ঘর ছাড়েন। তাদের বাড়িঘরে মিয়ানমার আর্মি ও স্থানীয় বৌদ্ধ রাখাইনরা আগুন দেয়ার পরই তারা বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেন গতকাল বুধবার সকালে।

এ দম্পতি বলেন, মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে প্রাণে রক্ষা পেলেও আসার পথে ক্ষুধা ও অসুস্থতায় অনেকে মারা যাচ্ছে।

বলিবাজারের বোগীরচরের বাসিন্দা আবু বক্করের ছেলে  সৈয়দ আহমদ বলেন, আমাদের সঙ্গে আসার সময় অসুখে পড়ে ৮ বছরের এক শিশু মারা গেলে তার লাশও ফেলে আসা হয়। তিনি আরো বলেন, গত শনিবার বিকালে আমরা নাফ নদীর তীরে পৌঁছি। চারটি নৌকা রোহিঙ্গাদের নদী পার করছিল। দুটি মিয়ানমার তীরের কাছে এবং একটি নদীর মাঝে ও অন্যটি বাংলাদেশের কাছে পৌঁছে।

এমন সময় ৪টি স্পিড বোটে চড়ে গুলি করতে করতে আসে মিয়ানমার আর্মি। তখন নদীর মাঝে থাকা নৌকাটি ডুবে যায়। এ নৌকার একজন সাঁতার কেটে মিয়ানমার ও চারজন বাংলাদেশে গিয়ে উঠতে পারলেও মারা গেছে ২০ যাত্রী। আর আমাদের নৌকা থেকে নামার সময় মারা গেছে বোগীরচরের ইউনুচের শিশুপুত্র আমিন (৮) এবং আবু তাহেরের ছেলে মোহাম্মদ আলম (৯)।

ডিয়লতলীর ৪৫০ পরিবারের অন্তত ৪ হাজার মানুষের প্রতিনিধি মোহাম্মদ নূর। তাকে সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা গত ২৫শে আগস্ট বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিই। সাতদিন জঙ্গলে থেকে শেষে বাংলাদেশে পৌঁছি।

আমাদের সঙ্গে আসার সময় পথেই মারা গেছে লব্বই ঢালার বাসিন্দা মো. হোছেনের পুত্র এনাল হোছেন (৩৫), ডিয়লতলীর মকবুল (৬৫) ও নুর মোহাম্মদ এবং হোয়াইকংয়ের বাসিন্দা নাসিমা খাতুন (৫০)। পথেই এহসানের স্ত্রী একটি বাচ্চা প্রসব করলেও চিকিৎসা না পেয়ে নবজাতকটিও মারা গেছে। মায়ের অবস্থাও ভালো নয়।

তুলাতলীর গণহত্যা থেকে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন কবির আহমদ ও তার পরিবার। কিন্তু পথে তুরাইনের মগপাড়ায় তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মৃত্যুর আরেক বিভীষিকা। সেখানে পৌঁছার পর স্থানীয় মগের ধারালো কিরিচের আঘাতে পরিবারটি প্রায় নিশ্চিহ্ন। শুধু তার ছোট্ট মেয়ে সাহেদা বেগম (৫) ও সে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।

সেখানে মারা গেছে, তার মা নুর আয়শা (৫০), স্ত্রী কুলছুম  (২৫), ভাই হামিদ হোসেন (৩০), হামিদের স্ত্রী লায়লা (২৫), বোন আনোয়ারা (১৮), রেহেনা (১৫), ভাই সৈয়দুল আমিন (৭) ও নিহত ভাই হামিদের ছেলে আনোয়ার ছাদেক (৩)। মঙ্গলবার রাতে স্বজনদের কাঁধে চড়ে নাফ ডিঙ্গিয়ে উখিয়ার বালুখালীতে আসেন গুলিবিদ্ধ আব্দুল আহের (৩১)। তার বাড়ি বুচিডংয়ের বাদানা এলাকায়।

তিনি বলেন, গত ২৮শে আগস্ট রওয়ানা দিয়ে ৮ দিন পর আমরা এদেশে আসি। আমাদের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ ছিল। লাইনের শুরু ও শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছিল না। আমার সামনেই তমবাজারের ইউনুচসহ ৫ জন মারা গেছে। তাদের লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রেখেই স্বজনরা কাঁদতে কাঁদতে আসে। পরে এক পাহাড়ি ঢালায় আরো তিনটা শিশু ও একটা মেয়ের লাশ দেখেছি। রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসার পথে পথে বহু লাশ পড়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে গত মঙ্গলবার বিকালে পালংখালীর আঞ্জুমান এলাকায় চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে ২ বছরের এক শিশু। মানবিক বিবেচনায় স্থানীয় কবরস্থানে তাকে সমাহিত করার সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে জানান স্থানীয় রফিক আহমদ।

মঙ্গলবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তুম্বরু সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া বৃদ্ধা এমুছন (৭০)। তাকে স্বজনরা খাটিয়ায় চড়িয়ে সীমান্তে পৌঁছাতে পারলেও অসুস্থায় তার শেষ রক্ষা হলো না বলে জানান মংডুর গারতিবিলের বাসিন্দা জাফর আলম। আসার পথে সন্তান প্রসবের চার দিন ধরে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় চিকিৎসার অভাবে একই এলাকায় আশ্রয় নেয়া ছকিনা খাতুনের (২৫) অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানান তিনি।

গতকাল বুধবার উখিয়ার বালুখালীতে গিয়ে দেখা যায় কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উভয় পাশে অবস্থান নিয়েছে শত শত রোহিঙ্গা। অনেকেই এক টুকরো পলিথিন সংগ্রহ করে পাহাড়ের ঢালে ও চূড়ায় কয়েকটি বাঁশ টানিয়ে মাথার উপর ছায়া পাতার চেষ্টায় ব্যস্ত। অনেকের সেই সম্বলও না থাকায় ঠাঁই রাস্তার পাশে ও জঙ্গলে বসে সময় পার করছেন। সেখানে সেভাবেই আগের রাতটি কেটেছে তাদের। তাদের সবাই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধার্ত। এরই মধ্যে ইসমাইল, কালামসহ অনেকেই অসুস্থ।

এরপর কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে ব্যাপক রোহিঙ্গার আনাগোনা। সেখানে যেন মানুষের ঢল নেমেছে। ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে এই ক্যাম্পে আসেন নুর আহমেদ ফকির। তিনি এখন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পক্ষে রোহিঙ্গাদের সেবায় কাজ করেন।

তিনি বলেন, না খেয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসায় রোহিঙ্গাদের সবাই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। তার উপর অনেকে অসুস্থ। আহত। তারা এসে থাকা ও খাবার ব্যবস্থা করতে পারছে না। ফলে অসুস্থতায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। এরই মধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পে আসা ৩০ রোহিঙ্গা মারা গেছে। তাদেরকে সেখানে দাফন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে আর ফিরতে না পারে সেজন্য সীমান্ত এলাকায় স্থল মাইন স্থাপন করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারাও মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। গত কয়েক দিনে মাইন বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছে। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে