সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন : পুরো এশিয়াকে সড়কপথে সংযুক্ত করতে চীনের মহাপরিকল্পনা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ানে রোড’ কথাটি শুনতে যতই মধুর লাগুক না কেন এর পিছনে এশিয়াজুড়ে চীনের একটি স্থায়ী বাজার তৈরি হবে এটা আর বুঝতে বাকি নেই কারও। ইতিমধ্যে তারা বেশ কয়েকটি দেশকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। বাধ সেধেছে শুধু ভারত। আর পাকিস্তানে চলছে এই মহাপরিকল্পনার একটি অংশ সিপিইসি। চায়না পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডর নামে পরিচিত এই পরিকল্পনাটি হচ্ছে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উচ্চভিলাষী একটি প্রকল্প। অত্যন্ত গোপনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় আরব সাগরের তীরবর্তি বেলুচিস্তানের গওদর গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের কাশগর শহরকে সংযুক্ত করা হচ্ছে।
সামরিক শক্তির চেয়ে অর্থনৈতিক আধিপত্যে বিশ্বাসী চীন দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের আধিপত্য বাড়াতে দ্রুত গতিতে বাস্তবায়ন করে চলেছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)। দেশটি তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এই মেগা প্রকল্পে হাত দিয়েছে। অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো এই করিডোর নিয়ে খোদ পাকিস্তানেই উঠছে তুমুল বিতর্ক।
চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক চীনের সরকারের জন্য একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছে, যাতে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) -এর সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও নীতিমালা তুলে ধরা হয়েছে।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে চীনকে মোট ৯০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হবে। যার মধ্যে ৬০বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরাসরি বিনিয়োগ করা হবে পাকিস্তানে। এই পরিমাণ অর্থের অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হবে। বাকি অর্থ পাকিস্তানের সড়ক, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, ফাইবার অপটিক ক্যাবল, কৃষি উদ্যোগ, পর্যটন ও সিমেন্ট কারখানা পুনর্নির্মাণে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে।
পাকিস্তান সিপিইসি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অধীর অপেক্ষা করে যাচ্ছে, কারণ দেশটি মনে করে যে, চীন থেকে প্রস্তাবিত বিপুল বিনিয়োগ পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতির চাকাকে সচল করবে। প্রাণ ফিরে পাবে আসবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। একই সঙ্গে সিপিইসিকে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশি দেশ ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কৌশলগত বিজয় হিসেবেই দেখছে দেশটির বিশেজ্ঞরা।
যাইহোক, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়ন হলে কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
প্রাসঙ্গিক সূত্র জানাচ্ছে, পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত চীন দেশটিকে ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দিয়েছে। এই সহায়তার অধিকাংশ ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনায়নের ক্ষেত্রে।
এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে চীন পাকিস্তান সম্পর্ককে মধুর চেয়েও মিষ্টি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন দেশটির সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। যদিও, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় কট্টরপন্থাকে নির্মূল করতে পাকিস্তানে ব্যর্থতা চীনকে কিছুটা হলেও বিরক্ত করে।
তবে করাচি, ইসলামাবাদ এবং অন্যান্য বড় বড় শহরগুলি থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকা থেকে সিপিইসি পরিকল্পনার রূপরেখা সম্পর্কে জেনে পাকিস্তানের বেশিরভাগ জনগণ নাখোশ। তারা মনে করে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে জনগণের কাছে আরও আলোচনা ও বিস্তারিত প্রকাশ করার দরকার ছিল।
সিপিইসি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের একটি বিশাল অংশ চীনের জিনজিয়াং প্রডাকশন অ্যান্ড কনসট্রাকশন কোম্পানি তৈরি করবে। যেটা চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারা পরিচালিত একটি সংস্থা। পাকিস্তানের সচেতন নাগরিক সমাজের সদস্যরা এটাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন বিষয়ে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের সুযোগ বলে মনে করছে। সিপিইসি বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে চীনের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছে তারা।
পাকিস্তানিরা আশা করেছিল, সিপিইসি পাকিস্তানের বিভিন্ন ইউনিটকে এক করে একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ অবকাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু এর পরিবর্তে এখন সেখানে প্রদেশভিত্তিক বিরোধ ও সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছে এবং উত্তেজনা বেড়ে গেছে।
অন্যদিকে, জিনজিয়াংয়ের মুসলিম বাসিন্দারা প্রায়ই চীনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে তারা নির্যাতনের শিকার হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই পাকিস্তানের শিল্প ও পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে জিনজিয়াংয়ের সম্পৃক্ততা পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
উপরন্তু, চীনা ইঞ্জিনিয়াররা করাচি থেকে পশ্চিমে দুটি ১১ হাজার মেগাওয়াট পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণ করছে। পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ ধরণের পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণ করা হলে এর তেজস্ক্রিয়তার বিরূপ প্রভাব পাকিস্তানের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির পরিবেশবিদরা।
পাকিস্তানি শিল্প উদ্যোক্তারা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, বিশ্বব্যাপী চায়না পণ্যের ব্যাপক প্রসারের কারণে তারা যে পণ্যগুলি উৎপাদন করছেন তা মার খেয়ে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় শিল্প। ২০০৭ সালে ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কারণে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। এমতাবস্থায় চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর হলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে দেশীয় শিল্প। চীনা পণ্যের একচেটিয়া বাজারে পরিণত হবে পাকিস্তান।
সিপিইসি বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে চীনের বেসরকারী ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত হবে পাকিস্তান। এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশটির অর্থনীতিবিদেরা। যদিও পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তারা এই আশঙ্কাকে সম্পূর্ণ অমুলক বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ভূতাত্ত্বিক বোদ্ধারা ইতিমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, সিপিইসি-তে চীনের সাথে পাকিস্তানের মধুচন্দ্রিমা বেশি দিন চলবে না। অচিরেই সিপিইসি নিয়ে পাকিস্তানীদের আশা ভঙ্গ হবে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের মতে, পাকিস্তানী বেসামরিক প্রশাসনের উপর সেনাবাহিনীর দৃঢ় প্রভাব, সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রণ ও অপ্রীতিকর হস্তক্ষেপের কারণে সিপিইসিতে যুক্ত চীনা সংস্থাগুলি খুব শীঘ্রই বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া, পাকিস্তানে তৎপর মৌলবাদী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর কারণেও পাকিস্তানের মাটিতে কাজ করা খুব কঠিন হবে চীনাদের জন্য। এই দুই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায়, সিপিইসি যদি পাকিস্তানের অর্থনীতিতে বড় ধরণের প্রভাবও ফেলে তবুও এই প্রকল্পের ভবিষ্যত খুব অনিশ্চিত ও ঝাপসা।
সিপিইসি সম্পর্কে রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের এই ভবিষ্যদ্বাণী যদি প্রমাণিত হয় তাহলে বেইজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কে বড় ধরণের ফাটল সৃষ্টি হবে। ফলস্বরূপ চীন-পাকিস্তানের মধুর চেয়ে মিষ্টি এই সম্পর্ক আর নাও থাকতে পারে।
চীনের প্রস্তাবিত সিপিইসি রোড পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিতর্কিত অঞ্চল দিয়ে যাবে। যা এই প্রকল্পের আরেকটি বিপজ্জনক দিক। ভারত এটাকে তার জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য হুমকি বলে মনে করছে।
১৯৬২ সালে চীন-ভারতের মধ্যে যুদ্ধের পর দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক শীতল হয়ে গিয়েছিল। যদিও ভারত-চীন সম্পর্ক কখনও খুব বেশি উষ্ণ ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে চীনের বিতর্কিত নেতা দালাই লামার প্রতি ভারতের অনুকূল্যে বেইজিং ক্রমাগত ক্ষুব্ধ। এছাড়া জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নিয়ে চীন বিভিন্ন সময়ে ভারতকে চাপে ফেলার চেষ্টা করে থাকে। এই সমস্ত বিষয় সত্ত্বেও, চীন এখনও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। চীনের সবচেয়ে বড় বাজার এখনও ভারত।
এদিকে শ্রীলংকা, নেপাল ও বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভারত। যাতে এই দেশগুলো চীনের প্রভাবমুক্ত হতে পারে। এদের মধ্যে শ্রীলঙ্কা এমন একটি দেশ যাকে ইতোমধ্যে ঋণের জালে বন্দি করে ফেলেছে চীন।
চীনের ঋণ নিয়ে শ্রীলংকার অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কথা মনে করে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা চীনের প্রস্তাবকে খুব সতর্কভাবে মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করেছেন। উল্লেখ্য যে, চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফর করেন এবং ঋণ, ক্রেডিট এবং অবকাঠামো প্রকল্পে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ সরকারকে চীন নয়, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সর্বাধিক জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই সবসময় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিল ভারত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও ব্যাপকভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিল দেশটি। এমনকি প্রভাবশালী দুটি দেশ চীন ও আমেরিকার বিরোধীতা সত্বেও বাংলাদেশকে সাহায্য দিয়ে গেছে ভারত।
সিপিইসি বাস্তবায়ন অবশ্যই চীনের দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তার ফসল। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব সুদূর প্রসারি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস