রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৪৫:৩৯

বর্বরতার লোমহর্ষক বর্ণনা : চোখের সামনেই গুলি করে ৭৩ জনকে হত্যা

বর্বরতার লোমহর্ষক বর্ণনা : চোখের সামনেই গুলি করে ৭৩ জনকে হত্যা

নিউজ ডেস্ক : মিয়ানমারের বর্বরতা বর্ণনা দিলেন আরকান রাজ্যের মংডু মেরুল্লার গুলিবিদ্ধ যুবক জাফর হোছন (৩০)। গতকাল শনিবার সাগর পথে টেকনাফ সৈকত উপকূল দিয়ে উঠে স্থানীয় সংবাদ কর্মীদের জানালেন মিয়ানমারের হিংস্র বাহিনীর নৃশংসতা।

তার বর্ণনামতে ২৫ আগস্ট ভোর রাত ৩ টা। হঠাৎ গোলাগুলির প্রচন্ড শব্দে শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। কাছেই বর্ডার গার্ড পুলিশ ক্যাম্প। সেদিক থেকেই আসছে গোলাগুলির শব্দ। জাফর হোছনের বুঝতে বাকি রইলো না কি ঘটছে।
চারদিকে ছুটাছুটি, গুলির শব্দ, আগুন। এর মধ্যেই জাফর হোছন এগিয়ে গেলেন ক্যাম্পের দিকে। দেখলেন তার গ্রামের শতাধিক যুবক লাঠি সোটা ও দা-কিরিছ নিয়ে লড়ছে।

এসময় বিজিপির গুলিতে তার চোখের সামনে ১০ জনের মতো আহত লোক ছটফট করতে থাকে। প্রায় সবাই তার গ্রামের পরিচিত মুখ। এক পর্যায়ে পিছু হটে যুবকরা। যে যেদিকে পারে প্রাণ বাঁচাতে পালাতে থাকে। হতবিহবল জাফর হোছেনও পালাতে থাকে তাদের সাথে। এসময় এক বর্মী পুলিশের লাঠির আঘাতে জ্ঞান হারান।

সকালের দিকে যখন তার জ্ঞান ফিরে নিজেকেই একটি ঝুপের ভিতর আবিষ্কার করে। গ্রামের দিকে তাকিয়ে দেখতে পান দাউ দাউ করে জ্বলছে গ্রামের অনেকগুলো বাড়ী। গ্রামের নারী পুরুষ প্রাণ বাঁচাতে পাহাড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। অপর দিকে গ্রামে সেনা ও পুলিশের টহল দেখতে পান।

আহত জাফর হোছেন কোন রকমে গড়িয়ে খুঁড়িয়ে এক কিলোমিটার দুরের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পরে খুঁজে বের করে স্ত্রী রুবিনা আক্তার (২১) ও দুই শিশু ফাহেদ (৩ মাস) ও মোঃ শাহেদ (১৯ মাস)। কিন্তু জাফর হোছন তার বাবা মাকে খুঁজে পায়নি এখনো।

আস্তে আস্তে সেনা ও পুলিশকে এড়িয়ে পাহাড়ি পথে এগুতে থাকে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। ১২ দিন পায়ে হেঁটে অনাহারে অর্ধাহারে পৌঁছে যায় রাখাইনের নাইক্ষ্যংদিয়া নামক দ্বীপে। সেখানে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকার জন্য অবস্থান করছে।

শনিবার ৯ সেপ্টেম্বর ভোরে সাগর পথে টেকনাফের লেঙ্গুরবিল সৈকত দিয়ে এদেশে ঢুকে।
জাফর হোছেন আরও জানান, রোহিঙ্গাদের উপর সেনা পুলিশের অত্যাচার দীর্ঘ দিনের অতিষ্ট হয়ে বছর খানেক ধরে সংঘঠিত হচ্ছিল রোহিঙ্গা যুবকরা। মাস ছয়েক আগে আরকান সালভেশন আর্মির কয়েক যুবক মেরুল্লা গ্রামের নির্যাতিত কয়েকশ যুবককে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য উদ্ধুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। এভাবে তারা কয়েকশ যুবককে সংগঠিত করে গোপনে লাঠিসোটা ও দা-কিরিচ দিয়ে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়।

অন্যান্যদের সাথে জপুর হোছেনও প্রশিক্ষন গ্রহন করেছিল। ২৫ আগস্টে সেনা ও পুলিশের হামলা ঠেকাতে এযুবকরাই চেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের অনেকেই প্রাণ হারান। আবার অনেকে রাখাইনে অবস্থান করছে। কেউ কেউ আহত হয়ে অথবা প্রাণ বাঁচাতে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে আসে এপারে।

আহত জপুর হোছেন পরিবার নিয়ে দিশেহারা খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সংকটে। ৯ সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে টেকনাফ পৌর এলাকার পল্লান পাড়ায় আলাপকালে এসব বর্ননা দেন তিনি। এসময় কয়েকজন সাহায্যকারী পৌঁছলে স্ত্রী রুবিনা খাদ্যের জন্য ছুটে যান রোহিঙ্গাদের ভীড়ে।

তার বর্ণনায় চোখের সামনে বৃষ্টি মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে একই গ্রামের ৭৩ জনকে। তিনি জানান,‘গ্রামের চারদিকে হঠাৎ করেই গুলির বিকট (টুসটাস) শব্দ। চমকে উঠে ঘর থেকে উঠানে বের হই। দেখি পাশের গ্রামের বাড়ীগুলো ধাউ ধাউ করে জ্বলছে। অগ্নি শিখা ও ধুঁয়ার কুন্ডলি আকাশে উড়ছে। মানুষ দিকবেদিক ছুটোছুটি করে পালাচ্ছে।

এসময় নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে বর্মী সেনারা। চোখের সামনে জুলেখাসহ পরিবারের ছেলে মেয়ে, নাতনীসহ ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। ব্রাস ফায়ারে নিহত হয়েছে জয়নাল ও আবুলের কিশোর পুত্র। আন্জুল হোছনের পুত্র বাইট্টাকে সরাসরি গুলি করেছে। বানু নামে এক মহিলাকে ঘরের ভিতর রেখে জ্বালিয়ে হত্যা করেছে’।

২৫ আগস্টের সকাল বেলার এসব বর্ণনা করতে গিয়ে নিজেই কেঁদে উঠেন ডাঃ আবদুল আজিজ। তিনি মংডু থানার দক্ষিণ শিলখালী গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের পুত্র। ১৯৭৮ সালেও শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ডাক্তারী পেশায় নিয়োজিত হন।
তিনি আরও বলেন, ‘চোখের সামনে এভাবে হত্যার দৃশ্য দেখে আমি এক মুহুর্তও বাড়ীতে অবস্থান করিনি। পরিবারের ৮ সদস্যকে নিয়ে অন্যান্য পরিবারের মতো আমিও পাহাড়ের দিকে ছুটেছি।

ওদিকে বর্মী সেনারা গ্রামের পর গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মানুষ প্রাণপন যেদিকে পারে ছুটছে। এসময় নির্বিচারে পাখির মতো গুলি চালিয়ে হত্যা করছে অনেককে। পালানোর ওই সময়ে কে মরছে দেখার ফুসরৎ ছিলনা। একই গ্রামের ৪০ থেকে ৫০টি পরিবার পাহাড়ে অবস্থান নেয়। পরের দিনে সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য রেখে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। এভাবে প্রায় ১৪ দিন অর্ধাহারে অনাহারে লুকিয়ে পাহাড়ী পথ দিয়ে হাঁটার পর দলবদ্ধ ভাবে বৃহস্পতিবার ৭ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্তে পৌঁছে শুক্রবার ৮ সেপ্টেম্বর রাতে শাহপরীরদ্বীপ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকি।

ডাঃ আবদুল আজিজ জানান, খবর নিয়ে জেনেছি উত্তর শীলখালী গ্রামে এক রাতেই ৭৩ জনকে পুড়িয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে। যুবতী মহিলাদের ধরে নিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেনি। পথে ও ধানক্ষেতে নারী শিশুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি।

গুলিবিদ্ধ ৫ রোহিঙ্গার শরীর পঁচে দূর্গন্ধ

আরকানে বর্বর সেনা হামলার ১৩ দিন পর গুলিবিদ্ধ হয়ে ১ নারী, ১ শিশু এবং ৩ জন রোহিঙ্গা কিশোর সীমান্ত অতিক্রম করে শুক্রবার রাতে টেকনাফে পৌঁছে।

৯ সেপ্টেম্বর সকালে আহতদের চিকিৎসার জন্য টেকনাফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখা যায় পঁচন ধরে দূর্গন্ধ বেরুচ্ছে শরীর থেকে। স্বজনরা কোলে কাঁধে করে তাদেরকে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেও জীবনের আশংকা কাটেনি তাদের।

গুলিবিদ্ধ ৩ জন রোহিঙ্গা হচ্ছেন বুচিডংয়ের রাচিদং এলাকার ইমাম শরীফ (১৭), আবুদল করিম (১৮), মংডু বড়ছড়ার ইব্রাহীম (২২) জমিলা খাতুন (৩২) ও ইতিলার গোঁয়াইং গ্রামের মোঃ সাফাত (৮)।
এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ আবদুল করিমকে ভাইয়েরা কাঁধে বহন করে ১৩ দিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করেন।

একটি ঝুড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে পায়ে ও হাতে গুলিবিদ্ধ আবদুল করিমকে পাহাড় জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে খাল বিল পার হয়ে এপারে আনতে গিয়ে নিজেরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসময় খাবার ও পানির সংকটে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটান তারা। আবার সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘ সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে পৌঁছেন তারা।

শুক্রবার ৮ সেপ্টেম্বর রাতে তাকেসহ অন্যান্যদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর আইওএম এর তত্বাবধানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় বলে জানান টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সুমন বডুয়া।
গুলিবিদ্ধদের স্বজনরা জানিয়েছেন, ২৫ আগস্ট বর্মী সেনাদের নির্বিচারে গুলি থেকে পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরে আহতাস্থায় পাহাড়ে অবস্থান করে। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করতে এতদিন লেগেছে। বর্তমানে আহতদের আইওএম’র হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের মংডু বড়ছড়া এলাকায় পঞ্চাশ জনের এক দল সেনা জড়ো হয়ে এ এলাকার অনেক লোককে গুলি করে হত্যা, যুবতী মেয়েদের অপহরণ করে। সাথে অধিকাংশ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় পালাতে গিয়ে ওই এলাকার যুবক ইব্রাহীমকে (২২) লক্ষ্য করে রকেট লাঞ্চার ছুঁড়ে।

লাঞ্চারের আঘাতে তাঁর ডান পা জর্জরিত হয়ে যায়। দুই দিন ব্যাথায় কাতর থেকে তাঁর স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা নুরজাহান ও শ্বশুরসহ ১১ জনের পরিবার ৩ দিন অতিবাহিত করে এপারে অনুপ্রবেশ করে বলে জানান আহতের শ্বশুর নুরুল ইসলাম।

এপারে আসতে গিয়ে হাবিরছড়া নৌকার মাঝি সাইফুল্লাহকে দিতে হয়ে জন প্রতি ১০ হাজার টাকা। আহত ইব্রাহীমকে টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ভর্তি করা হয়েছে।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে