সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৯:০৫:০৫

জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে বোরকা পরে পালিয়ে আসেন পূজা

জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে বোরকা পরে পালিয়ে আসেন পূজা

বিশেষ প্রতিনিধি : একুশ বছরের তরুণী পূজা মল্লিক। স্বামী আশিষ কুমার ও তিন বছরের সন্তান রাজাকে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। রাখাইন রাজ্যের মংডুর রেইক্যা পাড়ার ফকিরা বাজার এলাকায় বসবাস ছিল তাদের।

সেখানে একটি স্থানীয় বাজারে স্যালুন চালাতেন আশিষ। স্বামী ও সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল পূজার সংসার। কিন্তু গত ২৭ আগস্ট সকালে হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে সবার, তারপর বাইরে বেরোতেই দাউদাউ আগুনের তাপ, ঘরবাড়ি পোড়ানো লেলিহান শিখা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির সব পুরুষকে বেঁধে ফেলে কালো পোষাকধারীরা।

একে একে হত্যা করা হয় পূজার স্বামী আশিষ, শ্বশুর বলরাম, শাশুড়ি অনু বালা, দেবর খুশিস কুমার ও ননদ ঝুনু বালাকে। সবাইকে হত্যার পর পূজাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল কালো পোশাক পরিহিত কয়েকজন ব্যক্তি। তবে ভাগ্যক্রম বেঁচে যান তিনি।

এরপর প্রতিবেশী মুসলিম নারীদের সঙ্গে বোরকা পড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন পূজা। আশ্রয় হয়েছিল কুতুপালং ক্যাম্পে। মুসলিম পরিচয়ে সেখানেই সেখানেই ছিলেন এতোদিন। কিন্তু শনিবার কুতুপালং ক্যাম্পে থাকা এক নারীর কাছে পূজা মল্লিকের খবর পান হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত ক্যাম্পের বাসিন্দারা।

এরপর তাকে ও তার তিন বছরের শিশু রাজাকে নিয়ে আসা হয় পশ্চিম কুতুপালং হিন্দু ক্যাম্পে। যেখানে তার এক জীবিত ননদও আছেন। পরিবারের শুধু তারাই বেঁচে আছেন এখন। এমনটাই দাবি করেছেন পূজা মল্লিক। রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এসব কথা জানিয়েছেন প্রাণ নিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পূজা।

সেদিনের সেই দুর্বিসহ ঘটনায় ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে আরও অনেক তথ্য জানান তিনি। ছেড়ে আসা মংডুর ওই পাড়াতে ১২টি হিন্দু পরিবারের বসবাস ছিল বলেও জানিয়েছেন পূজা।

ভয়াবহ সেই দিনটি প্রসঙ্গে পূজা বলেন, ‘২৭ আগস্ট সকালে আমাদের গ্রামে হামলা করা হয়। হামলাকারীরা সবাই মুখোশ পড়া ছিল। তাই কাউকে চেনা যায়নি। আমাদের সামনেই পরিবারের সবাইকে গুলি করেও গলা কেটে হত্যা করে তারা। একবার আমি দেখেছি। এরপর আর দেখিনি। সহ্য করতে পারিনি। তারপর মুসলিম নারীদের সঙ্গে পালিয়ে আসি আমি।’

তরুণীটি বলেন, ‘১৮ বছর বয়সেই আশিষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বাবা-মা ছাড়াও দুই ভাই ও দুই বোন ছিল আমার। ভাইদের নাম নির্মল ও বিমল। বোনদের নাম শিখা ও লালা। বাবা রাজ কুমার স্যালুন চালাতেন। মা সীতা রানী গৃহিনী। শুনছি বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভাই-বোন বেঁচে আছে কিনা জানি না। আমার ননদ নিপূ বালা মামা বাড়িতে থাকার কারণে বেঁচে যায়। সেও সবার সঙ্গে পালিয়ে আসে। তবে আমি জানতাম না।’

কুতুপালং এলাকায় ২৭টি হিন্দু পরিবার আছে। তারাই মূলত এই ক্যাম্পের লোকদের দেখাশোনা করছেন। ক্যাম্পের পাশেই রান্নার জন্য একটি ঘর করা হয়েছে। সবাই এই ক্যাম্পেই অবস্থান করছেন।

বেশকিছু সামাজিক সংগঠনকেও দেখা গেছে রাখাইন থেকে আসা হিন্দু শরণার্থীদের সাহায্যে তাদের পাশে দাঁড়াতে। গতকাল দেখা যায় ঢাকা থেকে জাগো হিন্দু বাংলাদেশ নামে একটি সামাজিক সংগঠন তাদেরকে নগদ আর্থিক সাহায্য করতে। শরণার্থীদের মাঝে নগদ ৪০ হাজার টাকা তুলে দেন তারা।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বিনয় ভূষণ জয়ধর বলেন, ১৯ বছরের এক বিধবা সন্তান সম্ভব্য মা সহ ১৪ জন এ ধরনের মহিলাকে ও ৫১৭ জন মানুষের পাশে দাঁড়ানো চেষ্টা করছি মাত্র। তাদের পাশে থাকার জন্য আপনাদেরকেও অনুরোধ করছি। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে!!

রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবা ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তি’। এ প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যকর্মী সুমা শর্মা বলেন, ‘যেসব হিন্দু মায়েদের সন্তান হবে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পরীক্ষা করছি। এছাড়াও শিশুদের বাড়তি যত্ন নেওয়া হচ্ছে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু পরিবারগুলোকে পশ্চিম কুতুপালং ক্যাম্পে আগে থেকে অবস্থান করা ১৬টি হিন্দু পরিবার নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। একটি পরিত্যক্ত মুরগীর খামারেও থাকছে কয়েকটি পরিবার। সেখানেই রান্না করে খাওয়ানো হচ্ছে তাদের। এছাড়া ত্রাণও দেওয়া হচ্ছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় শতাধিক হিন্দু রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে-এমনটাই জানিয়েছেন সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা হিন্দু অধিবাসীরা৷ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ শতাধিক হিন্দু নারী-পুরুষ ও শিশু৷ হামলা নির্যাতন এবং হত্যার মুখে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের কুতুপালং হরি মন্দিরের কাছে একটি মুরগির খামারে আশ্রয় নিয়েছেন তারা৷

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত জানান, ‘আমরা কুতুপালং গিয়ে পালিয়ে আশা হিন্দুদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ আর আতে নিশ্চিত হয়েছি যে মিয়ানমারে শতাধিক হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে৷’
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে