শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৫৯:৪২

এখন কীভাবে বাংলাদেশ আসছে রোহিঙ্গারা

এখন কীভাবে বাংলাদেশ আসছে রোহিঙ্গারা

গিয়াস উদ্দিন, টেকনাফ থেকে : প্রথম দিকে মাঝিদের কাছে বিষয়টা ছিল মানবিক। ইঞ্জিনচালিত নৌকার তেলের টাকা জোগাড় করে দিতে পারলেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে তারা ছুটেছেন নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে।

মিয়ানমারের জলসীমা পেরিয়ে সে দেশের রাখাইন রাজ্যের বিপন্ন রোহিঙ্গাদের নিয়ে এসেছেন টেকনাফে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্রোত যত দীর্ঘ হয়েছে, মাঝিদের আচরণও তত বদলেছে। মানবিক বিষয়টি পরিণত হয়েছে বাণিজ্যে—এই তথ্য মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের।

এত দিন মাঝি ও জেলেরা বলতেন, নাফ নদীতে মিয়ানমারের জলসীমার আশপাশে বাংলাদেশের মাছ ধরার নৌকা দেখলেই গুলি ছুড়ত দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপি)। নৌকাসহ জেলে ও মাঝিদের ধরে নিয়ে দালালের (মিয়ানমারের জলসীমায় মাছ ধরা সে দেশের নৌকার কিছু মাঝি ও জেলে) মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করত বিজিপি।

তাহলে এখন কী করে বাংলাদেশের জেলে নৌকা মিয়ানমারের জলসীমা অতিক্রম করছে—এ প্রশ্ন করা হয় মাঝিদের কাছে। উত্তরে জানা গেল, রাখাইন রাজ্যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, তা আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়েই টের পান তারা।

ওই সময় ভুল করে কোনো নৌকা মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়লেও দেশটির বিজিপি মারমুখী আচরণ না করায় তারা বুঝতে পারেন, আবার রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হবে। একই খবর দালালেরাও (মিয়ানমারের নৌকার মাঝি) পৌঁছে দেয় তাদের কাছে।

২৪ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারের বিজিপি সে দেশের জলসীমা প্রায় ‘উন্মুক্ত’ করে বাংলাদেশি মাঝিদের জন্য। খালি নৌকা অবাধে মিয়ানমার জলসীমা পেরিয়ে নৃশংস নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের আনতে চলে যায় রাখাইন রাজ্যের মংডুর বিভিন্ন এলাকায়।

নাফ নদীর এক পাড়ে টেকনাফ অন্য পাড়ে রাখাইনের মংডু শহর। এই নদী বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত। আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের আনা-নেওয়ার কাজে ৮০০ নৌকা ব্যবহার করা হতো বলে জানান টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর হোসেন।

তিনি বলেন, এখন প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে দেড় শ নৌকা রোহিঙ্গাদের পারাপার করে। ছোট জেলে নৌকায় ১০ থেকে ১২ জন এবং মাঝারি আকারের নৌকায় ৩৫ থেকে ৪০ জন তোলা হয়।

প্রতি রোহিঙ্গার কাছ থেকে নৌকা পারাপার বাবদ গড়ে ৩ হাজার টাকা নেওয়া হয়। দিনে একটি নৌকা মংডু এবং টেকনাফের মধ্যে প্রায় পাঁচবার যাওয়া-আসা করে। মাঝারি আকারের একটি নৌকা রোহিঙ্গা পারাপার করে দিনে ১ লাখ টাকার মতো আয় করে।

নূর হোসেন বলেন, এখন ১০০ মাঝি রোহিঙ্গাদের আনা-নেওয়ার কাজ করছেন। একটি নৌকায় মাঝি ছাড়াও দুজন সহকারী থাকেন। মূলত টাকার লোভে পড়েই মাছ ধরার নৌকাগুলো ‘রোহিঙ্গা ধরার’ ব্যবসায় নেমেছে।

রোহিঙ্গাদের পারাপার করে দিনে একটি নৌকায় যত আয় হয় তার ২০ ভাগ পায় বাংলাদেশ অংশের দালালেরা, ১০ ভাগ পায় মিয়ানমারের দালালেরা। মাঝিদের একটি অংশ দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে নেন নৌকার মালিকেরা।

দুই দেশের ২৩টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা পারাপার : রোহিঙ্গা পারাপারে নিয়োজিত মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের পেরাংপুরু, নারীবিল, সিকদারপাড়া, মংনিপাড়া, দংখালী, ফাতংজা, মাংগালা, ফইন্যাপাড়া, সাইরাপাড়া ও নাইক্ষ্যংদিয়া—এই ১০টি এলাকায় নৌকা নিয়ে যান বাংলাদেশি জেলেরা।

সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের তুলে টেকনাফে নাফ নদীর ৫টি এবং বঙ্গোপসাগরের ৮টি পয়েন্টে নৌকা ভেড়ান তারা। নাফ নদীর ৫টি পয়েন্ট হচ্ছে নাইট্যংপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, হারিয়াখালী ও ঘোলারচর। বঙ্গোপসাগরের ৫টি পয়েন্ট হচ্ছে টেকনাফের পশ্চিমপাড়া, কাটাবনিয়া, মুন্ডার ডেইল, লেঙ্গুরবিল, জাহাজপুরা, মাথাভাঙ্গা, শীলখালী ও শামলাপুর ঘাট।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি দিন মোহাম্মদ বলেন, রোহিঙ্গা পারাপার করে অনেক নৌকার মালিক লাখপতি বনে গেছেন, এটি সত্য। তবে এসব নৌকাগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন।

কত ঘণ্টার যাত্রা : মাঝিরা বলেন, মংডুর নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে টেকনাফে আসার জন্য নাফ নদীতে ৪ কিলোমিটার এবং বঙ্গোপসাগরে ৮ কিলোমিটারসহ মোট ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। ভাটার সময় এই পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে ৬ ঘণ্টা, জোয়ারের সময় সাড়ে ৫ ঘণ্টা।

নাইক্ষ্যংদিয়া ছাড়া মংডুর অন্য এলাকা থেকে আসা নৌকাগুলো শুধু নাফ নদী পাড়ি দিয়েই টেকনাফে পৌঁছাতে পারে। দূরত্ব এলাকাভেদে (মংডুর) দুই থেকে তিন কিলোমিটার। সময় লাগে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা।

বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কড়াকড়ির কারণে এখন বেশির ভাগ নৌকা মংডুর নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে নাফ নদী ও সাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফে পৌঁছাচ্ছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে। ছোট নৌকাগুলো সাগরে চলার উপযোগী নয় বলে জানান মাঝিরা।

তারা বলেন, টানা নৌকা চালাতে গিয়ে মাঝিরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এ কারণে অনেক নৌকা চালাচ্ছেন মাঝির সহকারীরা। প্রবল ঢেউয়ের কবলে পড়লে তাদের অনেকে নৌকার নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে।

২৯ আগস্ট থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নাফ নদী ও সাগরে রোহিঙ্গাবাহী ২৩টি নৌকা ডুবেছে। এসব ঘটনায় মোট ১১২ রোহিঙ্গা এবং ১ বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রথম আলো
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে