ড. জসীম উদ্দিন আহমদ : গত চার সপ্তাহ মিয়ানমার সরকার রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উৎখাতের লক্ষ্যে সব নিপীড়ন, মারধর, খুন, বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস, লুটপাট, রাস্তায় ল্যান্ডমাইন বসানো ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় অত্যাচার করে মিয়ানমার থেকে উৎখাত করে চলেছে। রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাই মুসলিম। মিয়ানমার সরকারের অজুহাত যে ওই এলাকায় কিছু ‘জঙ্গি’ হামলা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার তাদের সরকারি শক্তি, অর্থাৎ মিলিটারি ও অন্যান্য সরকারি মাধ্যমে নিরীহ ও নিরপরাধ রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক শক্তি প্রয়োগ করছে। এই অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন বিপদসঙ্কুল পথে বাংলাদেশে চলে আসছে।
জীবন বাঁচানোর জন্য শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দুর্বল জরাক্রান্ত, ঝড়-বৃষ্টি-রোদ মাথায় নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। দীর্ঘ চলার পথে অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশু, নারী, পুরুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। রাখাইন প্রদেশে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর সব দোষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে মিয়ানমার সরকার দীর্ঘকালের নাগরিক ও বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের পাশবিক অত্যাচার করে দেশ থেকে উৎখাত করে চলেছে। এই চার সপ্তাহে চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে প্রায় দুই লাখ শিশু। এই প্রবল বর্ষা মওসুমে তাদের সব দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। মুষ্টিমেয় উগ্রবাদীর অপকর্মের জন্য একটি বড় জাতিগোষ্ঠীকে নিষ্ঠুরভাবে তাদের মাতৃ ও জন্মভূমি থেকে উৎখাত করে তাড়িয়ে দেয়া মানবতায় চরম লঙ্ঘন, ক্ষমার অযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে দণ্ডনীয় যুদ্ধাপরাধ। এই কর্মকাণ্ড এমন যে, মশারির ভেতর দু’টি মশা মারার জন্য মশারিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া।
সবচেয়ে বড় উদ্বিগ্নের বিষয় হলো মিয়ানমার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অং সান সু চি এই রোহিঙ্গা উচ্ছেদ ও উৎখাত কর্মের শীর্ষ হোতা। তিনি দীর্ঘকাল মানবতার বিশ্বখ্যাত প্রবক্তা হিসেবে সবার হৃদয় জয় করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এখন তার অন্তরের আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে। তিনি এখন প্রমাণ করেছেন যে, তিনি সাম্প্রদায়িক, মুসলিমবিদ্বেষী হিংস্র নারী। তার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা উচ্ছেদ ও উৎখাত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে যে, মিয়ানমার একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ এবং এই রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সু চি একজন শীর্ষ জঙ্গি।
মনে হয় রোহিঙ্গা মুসলিমদের উৎখাত করা (এথনিক কিনসিং) সু চির বহু দিনের স্বপ্ন ছিল। সু চির এই অন্তর্নিহিত আসল রূপের পরিচয় পেয়ে নোবেল কর্তৃপক্ষ হয়তো তাদের আগের বিবেচনা সম্বন্ধে চিন্তা করতে পারেন।মিয়ানমারের এই নির্মম ও অমার্জনীয় কর্মকাণ্ড পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক হামলার পরিচায়ক। বাংলাদেশ সরকার বহু ধৈর্যের সাথে মিয়ানমার সরকারের এই অন্যায় আচরণ সহ্য করে মানবতার কারণে এত বড় জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে ও তাদের থাকা-খাওয়া এবং দরকার মতে সব চিকিৎসার ব্যবস্থা করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বহু যুগ ধরে রাখাইন প্রদেশে নাগরিক ও বাসিন্দা। সামরিক জান্তা একসময় তাদের নাগরিকত্ব নাকচ করার চেষ্টা করেছিল। রাখাইন প্রদেশ রোহিঙ্গাদের জন্মস্থান, মাতৃভূমি ও নিজের দেশ। সেখানে বাস করা তাদের জন্মগত অধিকার। তাদের জন্মগত অধিকার লুণ্ঠিত করে উৎখাত করা মানবতাবিরোধী অমার্জনীয় অপরাধ।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভূমি রাখাইন প্রদেশে নিশ্চিত, নির্বিঘ্ন এবং শান্তিপূর্ণ চিরস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা সব দেশ, সব জাতি এবং জাতিসঙ্ঘের সম্মিলিত দায়িত্ব। অন্যথায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এত বড় অমানবিক অত্যাচার ইতিহাসে সব মানবজাতির ওপর কলঙ্ক হয়ে থাকবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক, সাবেক ডাইরেক্টর, জাতিসঙ্ঘ আণবিক
শক্তি এজেন্সি, ভিয়েনা
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস