হাসান ফেরদৌস:ঠিক দুই বছর আগে, সেপ্টেম্বর ২০১৫-তে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল তিন বছরের কুর্দি বালক আয়লান। পারেনি, পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। ভূমধ্যসাগরের পারে ভেসে উঠেছিল তার মৃতদেহ। সে ছবি দেখে পৃথিবীর মানুষের বিবেক ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিল। এখন ঠিক সেই একই ঘটনা ঘটছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিজের দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, আশ্রয় নিচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। সবার অবশ্য তেমন সৌভাগ্য হয় না। নাফ নদী পেরোতে গিয়ে অনেকেই পানিতে ডুবে মারা গেছে। এদেরই একজন ৪০ দিনের বালক আবদুল মাসুদ। মৃত সে বালকের ছবি ছাপা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
নিউইয়র্কের বাঙালি লেখক আদনান সৈয়দ ফেসবুকে আয়লান ও মাসুদের ছবি পাশাপাশি দিয়ে প্রশ্ন করেছেন, কুর্দি বালকটির ছবি দেখে বিশ্ব বিচলিত হয়েছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা শিশুটির ছবি দেখে কি সেই প্রতিক্রিয়া হয়েছে?
আদৌ কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি, সে কথা আমি বলব না। অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোগ্রাফার দার ইয়াসিনের তোলা মাসুদের সে ছবি বিশ্বের প্রতিটি প্রধান পত্রপত্রিকায় এসেছে, এই নিয়ে বিভিন্ন টিভি নেটওয়ার্কে আলোচনা হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলার নিন্দা হয়েছে, বাংলাদেশ যে কয়েক লাখ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে, তার জন্য সে প্রশংসিতও হয়েছে। প্রশ্ন হলো এত সবের পরেও রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ হচ্ছে না কেন? এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বলেছেন তাঁর দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আট লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
মিয়ানমারের শাসনক্ষমতা এই মুহূর্তে অং সান সু চির হাতে। কাগজ-কলমে শুধু আইন পরিষদের সদস্য হলেও তিনিই সে দেশের অঘোষিত প্রেসিডেন্ট। গত সপ্তাহে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন ‘বৈধ’ এমন দেশত্যাগী উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এর আগে সু চি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছিলেন, বর্মি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কথাও বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েই তাঁকে মানতে হলো অনেক রোহিঙ্গা দেশ ত্যাগ করেছে। কেন করেছে, কে তাদের নির্যাতন করছে, সে বিষয়ে তিনি অবশ্য টুঁ-শব্দটিও করেননি। অঘোষিত সরকারপ্রধান হলেও সু চির দুই হাত বাঁধা দেশের সেনাবাহিনীর কাছে। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার ক্ষমতা তাঁর নেই।
উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেবেন বলে যে আশ্বাস সু চি দিয়েছেন, বস্তুত তার সিকি পয়সা মূল্যও নেই। তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী শুধু যাদের ‘বৈধ’ কাগজপত্র রয়েছে, এমন রোহিঙ্গাদেরই ফিরিয়ে নেওয়া হবে, কিন্তু রোহিঙ্গারা তো অনেকে আগে থেকেই নিজের দেশে ‘অবৈধ’। দেশের জনসংখ্যা গণনায় তাদের হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এমন কোনো কাগজপত্র তাদের কাছে নেই, যা দেখে বর্মি সেনাবাহিনী এই উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরতে দিতে রাজি হবে। বলা হয়েছে, বাড়িঘরের ঠিকানার প্রমাণ দিতে হবে। যাদের
ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, শুধু জান হাতে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে যারা দেশ ছেড়েছে, সেসব প্রমাণপত্র তারা কোথায় পাবে? ফলে সু চির এই আশ্বাস শুধু কথার কথা, আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।
আন্তর্জাতিক চাপ বলছি বটে, কিন্তু প্রকৃত কোনো চাপ সু চি বা মিয়ানমারের ওপর নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ছাড়া অন্য কোনো প্রধান দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী নয়। যুক্তরাষ্ট্র মুখে মুখে অনেক কড়া কথা বলেছে বটে, কিন্তু মিয়ানমার সরকার বা সে দেশের সেনাবাহিনীর ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিবেচনা তার নেই। মিয়ানমারের দুই প্রধান প্রতিবেশী ভারত ও চীন, উভয়েই এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এমনকি রাশিয়াও কোনো কথা বলছে না।
এর কারণ কী, তা বোঝা অবশ্য কঠিন নয়। বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে হওয়ায় রাখাইন রাজ্যের সামরিক ও কৌশলগত গুরুত্ব বিস্তর। এখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ। রয়েছে তেল, গ্যাস, বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ পদার্থ। এসব কবজা করার উদ্দেশ্যে বর্মি সামরিক বাহিনী ৪০ বছর ধরে চেষ্টায় আছে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে তাদের জায়গার ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়। সে লক্ষ্যে নানা ছলছুতায় তারা রোহিঙ্গাদের জমি অধিগ্রহণ করেছে। এর বাইরে গেলার জন্য মুখ হাঁ করে আছে চীন ও প্রতিবেশী ভারত। গত এক-দেড় দশকে এই সম্পদের ওপর নজর পড়েছে বিদেশি করপোরেশনগুলোরও। আমেরিকা বা চীন একা ভোগ করবে, রাশিয়ার তা ভালো লাগার কথা নয়, ফলে তারাও গুটি গুটি পা পা করে এগোচ্ছে। বার্মায় পা ফেলার জায়গা করতে হলে সবার আগে চাই সে দেশের সেনাবাহিনীর সম্মতি। এই মুহূর্তে এরা সবাই সে কাজেই একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
চীনের ব্যাপারটা ধরুন। পৃথিবীর ৬৮টি দেশকে যুক্ত করে যে বিশাল ও অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্প সে হাতে নিয়েছে, রাখাইন রাজ্য তার অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া এখানেই তারা গড়ে তুলছে একটি সমুদ্রবন্দর, রাখাইন থেকে সংগৃহীত গ্যাস-তেল যার মাধ্যমে সরাসরি রপ্তানি হবে চীনে। চীনের মদদে একটি উন্মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনাও নিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
মুনাফার খোঁজে ভারতও এখন মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। সহিংসতা বন্ধের পক্ষে কথা বললেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলতে তারা নারাজ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত মাসে মিয়ানমারে এসেছিলেন।
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে সেখানে কার্যত কিছুই বলেননি তিনি। উল্টো জোর দিয়েছেন সন্ত্রাস বন্ধের ওপর। চীন মিয়ানমারে জাঁকিয়ে বসছে, ভারত স্বাভাবিকভাবেই সেটি সুনজরে দেখছে না। চীনের মতো তারাও রাখাইন প্রদেশ থেকে টু-পাইস কামাতে চায়, সে লক্ষ্যে একটি সরাসরি সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলছে তারা। এখানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও তারা আগ্রহী। কাজটা সহজ হয় যদি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে হাতে রাখা যায়, সে উদ্দেশ্যে সে দেশের সেনা কর্তাদের সঙ্গে ভারী অস্ত্র বিক্রি নিয়েও কথাবার্তা চালাচ্ছে ভারত।
চীন ও ভারত, এই দুই দেশকেই বাংলাদেশ নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের মতামতকে প্রভাবিত করায় বাংলাদেশের ব্যর্থতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বড় ধরনের ব্যর্থতা। বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বোঝানো যাবে, এই ভরসায় বাংলাদেশ এত দিন রোহিঙ্গা বিষয়টি একটি দ্বিপক্ষীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয়, তার ফলে সীমিতসংখ্যক রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়। কিন্তু রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বস্তুত নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা যে দেশ ছাড়ছে, তা থেকেই সে কথার প্রমাণ মেলে।
আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে তাদের পোড়ামাটি নীতি বদলানো যাবে না, বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ সে কথা বুঝতে পেরেছে। এই প্রশ্নের আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব রেখেছেন, তা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও রোহিঙ্গা প্রশ্ন সমাধানে একটি রূপরেখা হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু এর সাফল্য নির্ভর করবে বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলো, বিশেষত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও ভারতের সমর্থন অর্জনের ওপর। সে কাজে তেমন কোনো কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
ভারত, চীন ও রাশিয়া, এই তিন দেশই রাখাইন প্রদেশে ইসলামি সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করে কার্যত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বক্তব্যকেই সমর্থন করেছে। রাশিয়ার চেচনিয়ায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে একটি বিক্ষোভের পর পুলিশ বেশ কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কেউ যেন এই প্রশ্নে নতুন কোনো বিক্ষোভ না করে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আইসিস অনুপ্রবেশ করেছে, এমন একটি অভিযোগ ভারত তুলেছে। পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে সন্ত্রাসী সংগ্রহ করা হচ্ছে, এমন একটি অভিযোগ বাংলাদেশ থেকেও তোলা হয়েছে।
অধিকারহীন রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রতিরোধের উপায় হিসেবে সন্ত্রাসী রাজনীতি মাথাচাড়া দেবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু
নেই। আরাকান স্যালভেশন আর্মি এই নামে একটি গোপন বিদ্রোহী বাহিনীর তৎপরতার কথা শোনা যায়। মিয়ানমারের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে টিকে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব। বর্মি সেনাবাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে এই দল সম্প্রতি এককভাবে অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাই বলে প্রতিরোধ তো থামানো যাবে না। উড্রো উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলমান আমাকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার যত বাড়বে, সামরিক প্রতিরোধ তত ছড়াবে।
এই তথাকথিত স্যালভেশন আর্মি যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশে ঢুকতে বা ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে আরাকানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করেছে। বাংলাদেশের জন্য এটি সঠিক রণকৌশল, কিন্তু শুধু নিন্দা করে হাত গুটিয়ে থাকলেই চলবে না। আমরা রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ আছে এমন সব রকম সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে, বর্মি কর্তৃপক্ষকে এই কথাটা বোঝাতে হবে। প্রয়োজন হলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি ঠেকাতে বর্মি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যৌথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন। এই মুহূর্তে এ ধরনের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে কোনো জোর সমর্থন নেই। কিন্তু অবস্থা বদলাতে পারে যদি মিয়ানমার ও বাংলাদেশ নিজেরাই যৌথ উদ্যোগ নেয় তেমন একটি কার্যক্রমের পক্ষে আবহাওয়া গড়ে তুলতে। দুই বন্ধু রাষ্ট্র চীন ও ভারতকে যদি পাশে পাওয়া যায়, কাজটা হয়তো আরও সহজ হয়।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস