মহিউদ্দিন অদুল, উখিয়ার থেকে : মগের মুল্লুকে থামছে না নারকীয় তাণ্ডব। নির্বিচার নৃশংসতা চলছেই। প্রতিদিন নতুন নতুন রোহিঙ্গা পল্লীতে হানা দিচ্ছে মিয়ানমার সেনা ও বৌদ্ধরা। এখনো জ্বালানো হচ্ছে ঘরবাড়ি। সব ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে অসহায় মানুষ। একটু নিরাপত্তার খোঁজে ধরছে বাংলাদেশের পথ।
তবে, পালানোর পথেও হানা দিচ্ছে সেনা এবং বিদ্বেষপরায়ণ বৌদ্ধরা। নিরুপায় রোহিঙ্গাদের ওপর পথে পথে চালানো হচ্ছে নির্যাতন। কেড়ে নিচ্ছে তাদের শেষ সম্বলটুকু। গত দু’একদিনে বাংলাদেশে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা আসার পথের এমন নানা হামলা ও লুটের ঘটনার বর্ণনা দিলেন।
আবু ছিদ্দিক, হাকিম, তৈয়বাসহ বেশ কয়েকজন সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন গত রোববার দিনে ও রাতে। তাদের বাড়ি বুথেডং টাউনশিপের খিয়াম্বু ও আইয়ুব চর এলাকায়। সীমান্ত পেরিয়ে উখিয়ার খেদারখোলায় সহস্রাধিক রোহিঙ্গার যাত্রা বিরতিকালে গতকাল দুপুরে তাদের সঙ্গে কথা হয়। প্রাণ বাঁচাতে এর ৮ দিন আগে গত ১৭ই সেপ্টেম্বর তারা রাতের আঁধারে বসতভিটা ছাড়েন।
তারা বলেন, বাংলাদেশে আসার পথে লব্বইর ঢালার দু’পাশে মগপাড়া। সেখানে ১০ জন বৌদ্ধ যুবক তিন থেকে চার ফুট লম্বা দা-কিরিচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ায় ছিল মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। এর আগে-পরে কাটা-ছেঁড়া বহু লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। শিশু ও বৃদ্ধরা যাতে ভয় না পায় সেজন্য আমাদের লোকজন অনেক লাশের উপর চট-কাপড় ঢেকে দেয়। দলে বেশি লোক থাকায় বৌদ্ধরা হামলা চালায়নি। দলের শেষদিকে হামলা চালিয়ে অন্তত ১২ জনকে মেরে ফেলেছে।
একই দলে তাদের পরে আসেন ইউনুচ ও করিম। আগে আসা স্বজনরা একই পরিণতির সম্ভাব্যতা জানিয়ে কয়েকশ’ নয়, কয়েক হাজার মানুষের সঙ্গে দল বেঁধে আসতে বলেছিল তাদের। মুঠোফোনে পাওয়া সেই সতর্কবার্তা কাজ দেয়। তাই দলের মাঝামাঝিতে ছিল তারা। কিন্তু তাদের দলের শেষ প্রান্তের লোকজন সেই করুণ পরিণতির শিকার হলো।
গত ২৪শে সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে লব্বইর ঢালায় পৌঁছান। তারাও সেনা সদস্যদের তাক করা বন্দুকের আগে ওই রাখাইন যুবকদেরকে দেখে। কিন্তু দলের শেষের দিকে তারা হামলা চালায়। এতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছে বলে জানতে পারে পরের দলের সামনের ভাগের লোকদের মুখে। কিন্তু অন্য গ্রামের লোক হওয়ায় সেই হতভাগাদের নাম বলতে পারেননি তারা।
এরপর তারা ২৪শে আগস্ট সন্ধ্যার আগে নাফ নদের কাছে কোয়াংচিবংয়ে আসেন। সেখানে ৬ সেনা ও ২ রাখাইন যুবকের সামনে পড়েন। তারা সামনের লোকদের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল কেড়ে নিচ্ছিলো। তার চোখের সামনে আকবর নামে এক যুবকের কাছ থেকে মোবাইল ও সৌর প্যানেল কেড়ে নেয়। তার স্ত্রীর হাত থেকে কেড়ে নেয় সোনার চুড়ি। ততক্ষণে লোকজন বেশি জড়ো হয়ে গেলে সেনা সদস্যরা সরে পড়ে বলে জানান আকবর।
এরপরে মো. আমিন নামে এক যুবক এগিয়ে এসে বলেন, আমার কাছ থেকে একটি সৌরপ্যানেল, দুটো মোবাইল সেট ও একটি ত্রিপল তারা কেড়ে নিয়েছে। তবে খিয়াম্বুর ইলিয়াছ তার আট বছরের মেয়ে ছাবেকুন্নাহারের প্যান্টের ভেতরে লুকিয়ে আনেন কিছু জিনিস। সেখানে ছিল চারটি করে স্বর্ণের নাকফুল ও কানফুল এবং নগদ দেড় লাখ টাকা। ছোট ছেলেমেয়েদেরকে লুটের তল্লাশি না চালানোয় রক্ষা পান বলে জানান তিনি। তবে গোপী এলাকার এবাদুল্লার স্ত্রী ফরিদার (২০) নাকফুল এক সেনা সদস্য টান দিয়ে নিয়ে যায়।
বুথেডংয়ের জব্বারপাড়ার বাসিন্দা আট মাসের গর্ভবতী রহিমাসহ গ্রামবাসী বসতভিটা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন গত ১৬ই সেপ্টেম্বর। গ্রামের প্রতিনিধি জাকারিয়াকে মারধরের পর। কিন্তু তারা পালিয়ে আসার পথে হানা দেয় সেনা সদস্যরা। কিন্তু মানুষজন ছুটাছুটি শুরু করলে তারা পুরুষদের পথ আগলে রাখে। তাদেরকে আলাদা করে ফেলে। আর আসতে দেয়নি। আমার স্বামী মোহাম্মদ জুবাইরের সঙ্গে রয়ে গেছে দু’সন্তান।
পাঁচ বছরের তাসমিদা ও দু’বছরের বিবিজান। আমরা অন্তত ৫০০ নারী ও শিশু চলে আসলেও বাকি ৩০০ পুরুষ ও শিশু আটকে রয়েছে। জানি না তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে। আমাদের কিছুটা পেছনেই রাখাইনরা হামলা চালিয়ে ওই ১২ জনকে কেটে ফেলে। তার আগের দিন গত ২৩শে সেপ্টেম্বর লম্বইর ঢালায় আরো ৮ জনকে কেটে ফেলা হয়েছে বলে জানালেন আলী হোসেন। তারা স্বজনদেরকে বাংলাদেশের দিকে পথ এগিয়ে দিয়ে ফেরার পথে প্রাণ হারান। ওই দিনই তিনি লম্বইর ঢালা অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসেন।
পালিয়ে আসার সময় পেছন থেকে হামলায় মাত্র পাঁচ বছরের ছোট বোন আজিদাকে হারান আবদুল কাইয়ুম। তার বয়স ১৮। তিনি মংডু টাউনশিপের সীতরীক্ষা এলাকার শফিউল্লাহর ছেলে। কাইয়ুম বলেন, দু’দিন আগে ঘর থেকে বের হওয়ার পর গত ১৭ই সেপ্টেম্বর সীতরীক্ষা চরে আসি। সেখানে খোলা চরেই আমার বড় বোন ছমিরা (২০) এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এরপর তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। তাই সে রাত সেখানেই কাটিয়ে দেই।
পরদিন ১৮ই সেপ্টেম্বর সেনা সদস্যদের চোখ এড়াতে বয়ারঝুরির ঢালা পার হচ্ছিলাম। তখনই তাদের চোখে পড়ে যাই। আমার মায়ের কোলে ছিল বোনের একদিনের নবজাতক। বোনকে আমরা দু’ভাই খাটিয়ে বানিয়ে কাঁধে নিই। তখন ছোট বোন আজিদা মায়ের হাতে ধরা ছিল। দৌড়াদৌড়িতে কখন ছুটে গেল মা প্রথমে বুঝতে পারেননি। যারা হাঁটতে না পেরে পেছনে পড়ছিলো তাদেরকে সেনাবাহিনীর আগে থাকা মগ যুবকরা লম্বা দা-কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে আসছিলো।
হাফেজ ইউনুস, কাশেম, রাশিদা, লুৎফাসহ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ বলেন, যারা সংখ্যায় কম আসছে তাদেরকে পথে পথে সেনা ও মগরা গুলি, কোপ ও জবাই করে মারছে। অনেক লাশ পুড়িয়ে ফেলছে। সংখ্যায় বেশি থাকলে সামনের দিকে লুটপাট চালিয়ে সরে দাঁড়াচ্ছে। আবার অনেককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দু’হাত উপরে তুলেও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। দামি কিছু থাকলে তা কেড়ে নিচ্ছে। -এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি