শনিবার, ০৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:১৮:০৫

চ্যালেঞ্জে পুলিশ

চ্যালেঞ্জে পুলিশ

নিউজ ডেস্ক: আবারও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করা এবং ২০১৪ সালে নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা মোকাবেলার পর এখন তাদের পরিকল্পিত হামলা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। শুধু লেখক-ব্লগার ও বিদেশি নাগরিক নন, খোদ সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের এখন টার্গেট করা হচ্ছে। অতীতে প্রকাশ্যে হামলা হলেও এবারই প্রথম চলছে গেরিলা স্টাইলে গুপ্তহত্যা। গত ৪০ দিনে এক প্রকাশককে হত্যা ও তিনজনের ওপর হামলা, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, চেকপোস্টে পুলিশ খুন, হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে বোমা হামলা ও পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে হত্যার ঘটনায় সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ। এসব ঘটনায় তদন্তের তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় সুশীল সমাজের কেউ কেউ 'বিচারহীনতার' অভিযোগ এনেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামি, নাশকতার পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান জোরদারের কথাও বলা হয়। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে বিদেশিদের নিরাপত্তায় পুলিশ-র‌্যাবের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাকধারী সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে পরিকল্পনাকারীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। এহেন পরিস্থিতিতে গত কয়েকদিন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। চেকপোস্টে কোনো পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হলে গুলি করারও নির্দেশ দিয়েছেন তারা। তবে অনেকেই বলছেন, শুধু গুলি করে নয়, আরও কৌশলী হয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও তদন্ত গতিশীল করা জরুরি। এমনকি কোনো ঘটনার পর শুধু মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নামমাত্র 'সাজা' প্রত্যাহার নয়, তদারকির দায়িত্বে থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। অধিকাংশ ঘটনায় তদারক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না পুলিশ প্রশাসন। আবার একই পদে দীর্ঘদিন ধরে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা থাকায় কাজে এক ধরনের গতিহীনতা এসেছে। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ অ্যাডভোকেট শাহ্দীন মালিক বলেন, ব্লগার ও লেখকদের ওপর হামলার ঘটনায় উগ্রবাদীরা জড়িত। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব পুলিশের। তবে রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার করা বন্ধ না হলে এই বাহিনীর জন্য আরও কঠিন সময় আসতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, যদিও পুলিশ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তবে সর্বোচ্চ সক্ষমতার প্রয়োগ করে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার শক্তি ও সাহস এই বাহিনীর রয়েছে। এতে জনগণের সর্বাত্মক সহায়তা জরুরি। সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল করিম বলেন, দুই বিদেশি হত্যার পর থেকেই গ্রেফতার অভিযান জোরদার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারই আলোকে এখন পুলিশ মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, যে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশে বিভিন্ন সময় পুলিশ সদস্যদের সামনে থেকে 'ক্রাইসিস মুহূর্ত' মোকাবেলা করতে হয়েছে। গত তিন বছরে সহিংসতায় ২১ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। অতীতে পুলিশ সদস্যদের ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালানো হলেও এবারই প্রথম গুপ্তহত্যা চালানো হচ্ছে। আগে অধিকাংশ ঘটনায় ব্লগার ও লেখকদের বাসার বাইরে হামলা করা হতো। এখন খুনিরা ঘরের ভেতর গিয়ে হামলা করছে। আগে হামলায় শুধু দেশি অস্ত্র ব্যবহার করা হলেও এখন তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। অপরাধীরা তাদের কৌশল ও ধরনে পরিবর্তন আনছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে তারা নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। উগ্রপন্থিরা কৌশল পরিবর্তন করে হামলা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেলেও আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে পুলিশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি বিশেষ অপরাধ তদন্তে পুলিশের বিশেষ কোনো ইউনিট নেই। অনেক ক্ষেত্রে কিছু পরিকল্পিত অপরাধের আগাম গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে বোমা হামলা, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা ও পুলিশ খুনের ঘটনা প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য ওই এলাকায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (কনফিডেনসিয়াল) মনিরুজ্জামানের স্বাক্ষরিত ছয়টি বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো পুলিশ সদস্যের ওপর কোনো আক্রমণ হলে বিধি অনুযায়ী বলপ্রয়োগ করবেন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবেন। পেনাল কোডে বলা আছে_ তিন ক্ষেত্রে পুলিশ বলপ্রয়োগ বা গুলি করতে পারে। এক :আত্মরক্ষা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা। দুই :অবৈধভাবে জড়ো হওয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ। তিন :মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামির পলায়ন প্রতিরোধ। এসব ক্ষেত্রে যে কোনো পদমর্যাদার পুলিশ সদস্য গুলি করতে পারেন। তবে কোনো অধিনায়কের নেতৃত্বে তারা দায়িত্ব পালন করলে মাঠ পর্যায়ে সাধারণত তার মতামত নেওয়া হয়। এ ছাড়া কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করলে তার অনুমতি নিয়ে গুলি করে থাকেন। তবে রেওয়াজ অনুযায়ী গুলি করার আগে পুলিশ সদস্যরা আগে ভয় দেখাতে মৌখিকভাবে হুঁশিয়ার বার্তা দেন। এরপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়েন। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রথমে পায়ের নিচে গুলি করেন বা মামুলি অস্ত্র ব্যবহার করেন। চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশ গুলি করে থাকে। সাধারণত প্রতিদিন একজন পুলিশ সদস্যকে ২০ রাউন্ড গুলি দেওয়া হয়। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে বেশি গুলি দেওয়া হয়। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় কিছু উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গ্রেফতার করা অপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মদদদাতাদের খুঁজে বের করা, পুলিশের তদন্ত সংস্থা ও অপারেশনাল ইউনিটকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা, তদন্তে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আরও বাড়ানো ও সকল সংস্থার সমন্বিত যোগাযোগ বৃদ্ধি ও অপরাধীদের ডাটাবেজ তৈরি। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে ফোর্স মোতায়েনের আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথভাবে ব্রিফ করা। ইউনিট প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভোরে, সন্ধ্যায় ও ডিউটি পরিবর্তন সময়ে মোতায়েন সদস্যদের কর্মস্থল পরিদর্শন করা। পুলিশের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, ডিউটিতে যাওয়ার আগে পুলিশ সদস্যদের হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, বুট পরিধান নিশ্চিত করা। পুলিশ সদস্যদের ইস্যু করা সরকারি অস্ত্র-গুলি, যানবাহন ও অন্যান্য লজিস্টিক সামগ্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি সতর্কতা অবলম্বন।-সমকাল ০৭ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে