শনিবার, ০৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:০৫:৪৬

ঢাকার উপকণ্ঠে জঙ্গি আস্তানা

ঢাকার উপকণ্ঠে জঙ্গি আস্তানা

নিউজ ডেস্ক: রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গী, কামরাঙ্গীরচরসহ কয়েকটি এলাকায় আস্তানা গেড়ে বসেছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা। গত দুই বছরে ব্যাংক ডাকাতিসহ ছিনতাই ও ডাকাতির অর্ধশত ঘটনা ঘটেছে এসব এলাকায়। ছদ্ম পরিচয়ে ভাড়া বাসায় থেকে অপরাধীরা একের পর এক ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব স্থানের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে আশুলিয়া ও সাভার। বড় ঘটনায় কিছু আসামি গ্রেপ্তার হলেও পরিকল্পনাকারীরা থাকছে আড়ালেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অপরাধ সংঘটন ও গোপন বৈঠকের জন্য আশুলিয়া এলাকাকে ব্যবহার করছে জঙ্গি ও উগ্রপন্থীরা। এ এলাকায় চলতি বছর সংঘটিত কয়েকটি অপরাধের পেছনে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)ও জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা জড়িত বলে তথ্য মিলেছে। আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় গত বুধবারের পুলিশ হত্যার ঘটনাটিও একই ধরনের চক্র ঘটিয়েছে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা। নির্ভরযোগ্য একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি ও আটজনকে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন আব্দুল্লাহ আল বাকী ওরফে মাহফুজ ওরফে হাফিজ ও আসিফ আজওয়াদ নামের দুই জঙ্গি নেতা। দুজনই আগে জেএমবির নেতা ছিলেন, পরে হয়েছেন এবিটির অনুসারী। ওই ঘটনায় পুলিশ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে, যারা একই মতাদর্শের। দলটি টঙ্গীর আউচপাড়া, আশুলিয়ার কাঠগড়াসহ কয়েকটি এলাকায় ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করে। একই দল গত ১০ মার্চ টঙ্গীর বোর্ডবাজার এলাকায় একজনকে হত্যা করে ছিনতাই করে। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও মাহফুজ ও আসিফকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এরই মধ্যে রাজধানীতে চাঞ্চল্যকর খিজির খান খুনের ঘটনায়ও জেএমবি নেতা মাহফুজের নাম এসেছে। এই হত্যাকারী দলটিও আশুলিয়ায় বৈঠক করে। এরই মধ্যে এক আসামিকে সাভার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সূত্র মতে, সম্প্রতি গাবতলীতে পুলিশ হত্যা ও হোসেনী দালানে বোমা হামলার পরিকল্পনাও করা হয় আশুলিয়া ও কামরাঙ্গীরচরে বসে। এসব ঘটনার সূত্র ধরে কনস্টেবল মুকুলের খুনি শনাক্ত করারও চেষ্টা চলছে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার উপকণ্ঠগুলোতে জঙ্গি, ডাকাত, সন্ত্রাসীসহ অপরাধীরা গোপনে অবস্থান করে অপরাধ করছে- এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে। বিশেষ করে আশুলিয়ায় বেশি হচ্ছে। আমরা সোর্স নিয়োগ করে অনেক আসামি ধরেছি।’ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক এস এম মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান বলেন, ‘এসব ঘটনার পেছনে কারা আছে এবং তারা কোথায় অবস্থান করে তা নিয়ে আমরা এখনো কাজ করছি। সব রহস্যই বের হবে। আমাদের একটু সময় দেন।’ আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ডাকাতি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিন ডাকাতকে ধরে ফেলেছিল জনতা। তাদের মধ্যে একজন গণপিটুনিতে নিহত হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার করে আরো আটজনকে। তাদের মধ্যে আল আমিন, বোরহান উদ্দিন, জসিম উদ্দিন, আব্দুল বাতেন, মোজাম্মেল হক ও মাহফুজুল ইসলাম শামীম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা সবাই জঙ্গি বলে দাবি পুলিশের। তবে তাদের অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকের উৎস সম্পর্কে তথ্য মেলেনি। গ্রেপ্তার করা যায়নি পরিকল্পনাকারীদের। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, ‘১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মামলাটির তদন্তকাজ এখনো শেষ হয়নি। আসামিরা সবাই জেএমবি ও আনসারুল্লাহর সদস্য বলে জানিয়েছে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর বাড্ডা থেকে গত ৩১ মে গ্রেপ্তার করা মাহফুজুল ইসলাম শামীম জবানবন্দিতে জানান, ব্যাংক ডাকাতির সময় সেখানে অপারেশনাল নেতৃত্ব দেন তিনি। তাঁর কাছে থাকা রাইফেল দিয়ে তিনি ব্যাংকের ভেতর থেকে গুলি করেন। পরে গ্রেনেড-বোমাও ছুড়ে মারেন। ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মাহফুজ ও আসিফ আজওয়াদের নাম জানান তিনি। শামীম টঙ্গীর আউচপাড়ায় সহযোগীদের সঙ্গে সুমন ছদ্মনামে অবস্থান করে ডাকাতিতে অংশ নেন। স্বীকারোক্তিতে শামীম আরো জানান, শুধু তহবিল সংগ্রহই নয়, ব্যাংক ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করাও ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক ডাকাতির সময় গ্রেনেড, বোমা, দুটি পিস্তল ও একটি পয়েন্ট টুটু বোরের রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে। টঙ্গীর আউচপাড়ায় খালেক নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ৯ মাস আগে ভাড়ায় ওঠে দলটি। ওই আস্তানা থেকে দুটি অপারেশনাল নকশা উদ্ধার করে পুলিশ। ওই নকশার সঙ্গে ডাকাতি হওয়া ব্যাংকের দ্বিতীয় তলা থেকে উদ্ধার করা নকশার হুবহু মিল পাওয়া যায়। এ ছাড়া টঙ্গীর আস্তানা থেকে আশুলিয়ার সাতনগর, বটতলা, কাঠগড়া ও জামগড়া এলাকার চারটি বাড়িতে আসামিদের অবস্থানের তথ্য পান তদন্তকারীরা। গ্রেপ্তার হওয়া বাতেন আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় ‘আরবিআর’ নামে একটি ইউনানি চিকিৎসাকেন্দ্রের কর্ণধার। উগ্রবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী বাতেন ডাকাতদলকে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, আসামি মোজাম্মেলকে কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করার পর রিমান্ডে নেওয়া হয় শামীমের সঙ্গে। পরে মোজাম্মেলও জবানবন্দিতে জানান, কামরাঙ্গীরচরে তৈরি পোশাক বিক্রির ব্যবসা করতেন তিনি। উগ্রবাদী ডাকাতদলটিকে তিনি ইন্ধন দিয়েছেন। কাঠগড়ার ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটার দূরে রফিক নামের একজনের বাড়িতে তিনি ভাড়া ছিলেন। মোজাম্মেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর রফিক গা ঢাকা দেন। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা এএসপি নাজমুল হাসান ফিরোজ বলেন, দলটি অর্থ সংগ্রহ করতে এবং নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে ডাকাতি করে। পলাতক মাহফুজের বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার কাজাইকাটা এলাকায়। জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অনুসারী মাহফুজ আগে জেএমবির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া শামীম ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জেএমবি নেতা সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে শামীম আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দলে যুক্ত হন বলে ধারণা পুলিশের। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ২৩ আগস্ট বগুড়ায় জেএমবির প্রশিক্ষণ শিবিরে পুলিশের অভিযানকালে পালিয়ে আসেন শামীম। এই জঙ্গিদের নেপথ্যে কারা, তা বের করার চেষ্টা চলছে। জানা গেছে, বোর্ডবাজার এলাকায় ১০ মার্চ বিকাশের এজেন্ট রবিন মিয়াকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে পৌনে দুই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। শামীম তাঁর জবানবন্দিতে জানান, তাঁরা আউচপাড়ার আস্তানায় থেকেই ওই ছিনতাই করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির বিশেষ সুপার (এসএস) মির্জা আব্দুল্লাহ-হেল বাকী বলেন, ‘জয়দেবপুর থানায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত এখনো চলছে। জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি আমরা।’ গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ৫ অক্টোবর রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৪ অক্টোবর জেএমবির সংগঠক তারিকুল ইসলাম মিঠুকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। ওই ঘটনার নেপথ্যেও ‘মাহফুজ’ নামের এক জেএমবি নেতার নাম উঠে আসে। এ পর্যন্ত পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজনই জেএমবির সদস্য। সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মোস্তফা আহমেদ রাসেল নামের একজনকে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রধান আসামি মিঠুর সঙ্গে জেলখানায় পরিচয় হয় রাসেলের। তিনি আশুলিয়া এলাকায় ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। মিঠু জবানবন্দিতে জানান, খিজির খানকে হত্যা ও বাড়ির মালপত্র লুট করার পর তাঁরা আশুলিয়ায় মিলিত হন। মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা, গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি-উত্তর) মাহফুজুল ইসলাম বলেন, এখন তারা পেশাদার ডাকাতদের জেএমবির সদস্য বানাচ্ছে, নাকি শুধু ডাকাতি করার জন্যই ডাকাতদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ২২ অক্টোবর গাবতলীর পুলিশ চেকপোস্টে এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে কুপিয়ে হত্যার পর পালানোর সময় মাসুদ রানা নামে এক শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কামরাঙ্গীরচরের একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচটি বোমা। এর এক দিন পর পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে বোমা হামলা চালানো হয়। দুই ঘটনায় ব্যবহৃত বোমাগুলো ছিল একই ধরনের। গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান, এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, হাতে তৈরি একই রকম গ্রেনেড আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতিতেও ব্যবহার করা হয়েছিল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত-শিবিরের একটি নাশকতাকারী চক্র বড় পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা সম্প্রতি গাজীপুরের শালবন ও আশুলিয়ায় বৈঠক করেছে বলেও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এসব তথ্যসূত্র ধরে তদন্ত চলছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, ধারাবাহিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীটির নেপথ্যে কারা আছে এবং তাদের অবস্থান যাচাই করা হচ্ছে। এখন সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচরসহ কয়েকটি এলাকায় বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ আগস্ট আশুলিয়ার রুস্তমপুর গুদারাঘাটের পূর্বপার এলাকায় ব্যবসায়ী আবদুল ওহাব মাতবরকে কুপিয়ে ও গুলি করে ১০ লাখ টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। গত ৭ এপ্রিল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকার আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কে গুলি করে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতনের ২২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে ৩১ মার্চ আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংকের ইয়ারপুর শাখা কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক সুবল দেবনাথকে গুলি করে ও কুপিয়ে দুর্বৃত্তরা দেড় লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।-কালের কন্ঠ ০৭ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে