শনিবার, ০৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০৭:৪২:০৪

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ও অন্তরালের কিছু কথা

 ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ও অন্তরালের কিছু কথা

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : আজ ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর।ঘটনাবহুল ১৯৭৫'র এই দিনে জাতির ইতিহাস এক নতুন মোড় নেয়।ফলে নানা দিক থেকেই এ দিবসটি গুরুত্ব বহন করে।অনেকের মতে দিনটি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বা ‘সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান দিবস’, আবার কারো মতে ‘সেনা হত্যার’ দিন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দিবসটি নিয়ে দুটি পক্ষ পরস্পর বিপরীত মেরুতে।নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে জাতি দ্বিধা-বিভক্ত।সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমানের পক্ষের সমর্থক-অনুসারীরা ৭ নভেম্বরকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে ঘটা করে পালন করেন। তাদের মতে এদিন সিপাহী-জনতা সেনানিবাসের বন্দিদশা থেকে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে নস্যাৎ হয়ে যায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী সব ষড়যন্ত্র। আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ। এদিক বিবেচনায় বিএনপি ক্ষমতা থাকাকালে ৭ নভেম্বর সরকারি ছুটি ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবেই পালন করে দিবসটি।ক্ষমতার বাইরে থেকেও অনেকটা আড়ম্বরপূর্ণভাবেই সারাদেশে দিবসটি পালন করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এই দিনটিকে গভীর ষড়যন্ত্রের তথা সেনা হত্যার দিন বলে মনে করেন।তাদের মতে, এদিনে নির্বিচারে সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়।প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে এদিনের আসল বিপ্লবকে হত্যা করা হয়েছিল।মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একেবারে নিশ্চহ্ন করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই এটা করা হয়েছিল।ফলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পর বাতিল করেছিল সরকারি ছুটি।পরে ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারও এ দিবস পালন থেকে বিরত থাকে।সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও দিবসটি পালন করা থেকে বিরত। এখানে কারো মতকেই ছোট করে দেখছি না।তবে জাতির এই দ্বিধাবিভক্তির কারণগুলো বিশ্লষণের দাবি রাখে।প্রত্যেকে পক্ষ নিজদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সমর্থকদের বুঝানোর চেষ্টা করে।আসলে আমরা তো দলকানা।ফলে দল যা বলবে সেটাই বিবেচ্য, এর বাইরে চিন্তার সুযোগ নেই। এখন দেখা যাক- ভিনদেশিরা কীভাবে বিশ্লেষণ এবং কীভাবে দেখছেন ওই নভেম্বরের ঘটনাগুলো।ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ১০ নভেম্বর ১৯৭৫ এক তারবার্তার মাধ্যমে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে তথ্য জানিয়েছিলেন।১৯৭৫ ঢাকা-০৫৪৭০ ক্রমিকের ওই তারবার্তাটি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ৩৪ বছর পর ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় অবমুক্ত করা ওই গোপন তারবার্তা থেকে নভেম্বরের ঘটনাগুলো সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়।ওই তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত বোস্টার বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। তার পর্যবেক্ষণের অংশ বিশেষ এমন- বোস্টার তার দীর্ঘ বিশ্লেষণ শুরু করেন এভাবে, ‘চিফ অব দ্য আর্মি জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পদোন্নতি না পেয়ে ব্যর্থতায় বিষণ্ণ ছিলেন।১৫ আগস্ট মুজিবকে হত্যার পর খালেদের কিছু সহকর্মীর পদোন্নতি হলেও তার হয়নি বরং মেজররা সন্দেহভাজন যেসব কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করেছিল, এর মধ্যে খালেদের নামটিও ছিল। আমরা এটা নিশ্চিতভাবে জানি না যে মোশাররফ সংঘাতের রূপকার ছিলেন কি না।যদিও অনেকে তেমনটা মনে করেন।একটি ভালো সূত্র আমাদের জানিয়েছিল, মোশতাক সরকারে মেজরদের বিশেষ ভূমিকা পালনকে যারা সুনজরে দেখেননি, খালেদ মোশাররফ তেমন কিছু অধীনস্থদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।মেজরদের বিশেষ ভূমিকার কারণে যেসব বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্যে কিছু সামরিক কর্মকর্তাদের হয়রানি অন্যতম।এই সূত্র আরও জানিয়েছে, খালেদ মোশাররফের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, তেমন কোনো রক্তপাত ছাড়াই পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।তার অধীনস্থদেরও পরিকল্পনা ছিল সেটাই।যদিও তিনি সন্দেহাতীতভাবে নিজের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ সম্পর্কেও মনোযোগী ছিলেন।’ এ দলিল থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, মোশাররফকে ভারতপন্থি মনে করেই বিদ্রোহী সাধারণ সৈনিকেরা জিয়াউর রহমানের দিকে ঝুঁকেছিলেন।বিশ্ব এ সময় বাংলাদেশে তিনটি সরকারের পালাবদল প্রত্যক্ষ করেছিল।বোস্টারের ভাষায়, এ সরকারগুলো আমেরিকাবিরোধী ছিল না।তারা ছিল না ভারত কিংবা সোভিয়েতপন্থি।৩ নভেম্বরের অবস্থা সম্পর্কে কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল ১৯৯৮ সালে লিখেছেন, ৩ নভেম্বর ভোর থেকে শুরু হয় ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের সঙ্গে টেলিফোনে আমাদের বাগযুদ্ধ।আমাদের দিকে খালেদ মোশাররফ, ওদিকে রশিদ, জেনারেল ওসমানী ও সর্বোপরি খন্দকার মোশতাক। বোস্টার লেখেন, ‘খালেদ মোশাররফ ও তার মিত্ররা সোমবার (নভেম্বর ৩) খুব সকালে সেনানিবাস ও ঢাকা নগরের বেশির ভাগ জায়গার নিয়ন্ত্রণ নেয়।এবং মোস্তাক সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনে ঢাকার আকাশে মিগ যুদ্ধবিমান ও সশস্ত্র হেলিকপ্টার চক্কর দেয়।এর আরেকটি লক্ষ্য ছিল মোস্তাক সরকারের অনুগত ট্যাঙ্ক বাহিনীকে ভয় দেখানো।এই প্রেক্ষাপটে খালেদ মোশাররফ মোশতাকের কাছে চারটি শর্ত দিলেন।প্রথমত, মোশাররফ চিফ অব স্টাফ হিসেবে ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবেন।দ্বিতীয়ত, মেজরদের সেনাবাহিনীর নিয়মিত শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে।তৃতীয়ত, সরকারের প্রতি অনুগত ট্যাঙ্ক বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে হবে।এবং চতুর্থত, মোশতাক স্বপদে বহাল থাকবেন।খালেদের পক্ষে এসব দাবির দৃশত বড় লক্ষ্য ছিল রক্তপাত এড়ানো, যা কি না ভারতের হস্তক্ষেপ ডেকে আনতে পারত।মোশতাক দিনভর আলোচনার পর শেষে পর্যন্ত খালেদের এসব দাবি মেনে নিলেন।তবে মোশতাক তাকে রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্য কৃতজ্ঞ মেজর ও তার কিছু সহকর্মীর জন্য বাংলাদেশ ত্যাগের ব্যবস্থাও সেরে নেন। মোশাররফের সঙ্গে এ ধরনের আপসে পৌঁছানোর আগে মোশতাক সরকার কুমিল্লা থেকে সেনাবাহিনীর সাহায্য আশা করেছিল।কিন্তু কুমিল্লার অধিনায়ক তখন এই যুক্তিতে মোশতাকের নির্দেশনা নাকচ করলেন যে শুধু সেনাবাহিনী প্রধান কিংবা চিফ অব জেনারেল স্টাফের নির্দেশ ছাড়া তারা কোনো অভিযানে যেতে পারেন না।সেনাপ্রধান জিয়া তখন অন্তরীণ আর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন মোশাররফ।’ বোস্টার এ পর্যায়ে আরেকটি রক্তপাত অর্থাৎ জেল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে লিখেছেন, আমাদের এটা বিশ্বাস করার সংগত কারণ ছিল যে খন্দকার মোশতাককে হত্যার চেষ্টা করা হলে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, সে বিষয়ে একটি কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ছিল।নিহত ব্যক্তিরা মোশতাকের সাবেক সহকর্মী এবং এখন তার রাজনৈতিক শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। বোস্টারের বর্ণনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামরুজ্জামানকে ঢাকা কারাগারে ৩ নভেম্বর খুব সকালে হত্যা করা হয়।বোস্টার এরপর মেজরদের দেশত্যাগে খালেদ মোশাররফদের সম্মতি সম্পর্কে মন্তব্য করেন।তার কথায়, ‘ওই দিন (৩ নভেম্বর) শেষ বিকেলে মেজরদের দেশত্যাগে মোশাররফের সম্মতি রহস্যাবৃত বলে মনে হয়।’ বোস্টার লিখেছেন, ‘মেজরদের দেশ ত্যাগের ফলে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির কিছুটা অবসান ঘটে।মঙ্গল ও বুধবার মোশতাক ও মোশাররফের মধ্যে সমঝোতা চলছিল। এর ফল হিসেবে মঙ্গলবার রাতে চিফ অব স্টাফ হিসেবে মোশাররফের অভিষেক ঘটে এবং বৃহস্পতিবার খুব সকালে মোশতাক পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে ঘোষণা আসে, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হবেন। সায়েম ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।এবং তাৎক্ষণিক সংসদ বিলুপ্ত করেন।’ বোস্টার লিখেছেন, ‘কিন্তু এটা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট যে মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণ সেনাবাহিনীতে ছিল অপ্রীতিকর। কারণ জেনারেল জিয়া স্পষ্টতই সেনাবাহিনীতে তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিলেন।এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো, সত্যতা থাকুক আর না-ই থাকুক, মোশাররফকে ব্যাপকভাবে ভারতীয় নীতির একজন চালিকা হিসেবে দেখা হতো।সেনাবাহিনীর মধ্যে এই যে ধারণা তা আরও অতিরঞ্জিত হয় ৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) যখন মুজিবপন্থিদের মিছিল বের হয় এবং পরদিন জেল হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়।’ শুক্রবার খুব সকালের দিকে সেনাবাহিনীর নিম্নপদের সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করেন।তারা দ্রুততার সঙ্গে মোশাররফের সমর্থকদের উৎখাত করেন।এবং সব রকমের বিবরণ থেকে জানা যায়, তারা এ সময় মোশাররফকে হত্যাও করেন। 'সারা রাত ধরে শহর জেগে থাকে গুলির শব্দে।এটা চলে শুক্রবার সারা দিন।মোশাররফের অপসারণের পর অধিকাংশ গোলাগুলির ঘটনা ছিল উল্লাসসূচক।একটি কর্তৃপক্ষীয় সূত্র আমাদের বলেছে, মোশাররফকে উৎখাতের ঘটনায় প্রায় ৩০ জন খুনের শিকার হয়।অবশ্য অন্যান্য সূত্রগুলো এই সংখ্যা কয়েক শ বলেছে।’ বোস্টার এরপর মন্তব্য করেন, ‘সেনাবাহিনীর নিম্নপদে সফল বিদ্রোহের ঘটনা একটি নতুন সমস্যার জন্ম দেয়।শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা চরম বিশৃঙ্খলামূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। যেসব সেনা কর্মকর্তার প্রতি তাদের রাগ পুঞ্জীভূত ছিল, অনেকেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।এমনকি তারা তাদের ভবিষ্যৎ ভালো-মন্দ থাকার প্রশ্নে এখন সেনা নেতৃত্বের কাছে দাবিদাওয়া তুলতে শুরু করেছে।গোটা সপ্তাহ জুড়ে এ কথাই জানা গেছে, প্রতিশোধপরায়ণ সিপাহিদের ভয়ে বিপুলসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা পালিয়ে গেছেন কিংবা সেনানিবাস থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখছেন।আমরা শুনতে পাচ্ছি বহু সেনা কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীরা নিহত হয়েছেন।’ ওই তারবার্তা থেকে আরও জানা যায়, ৭ নভেম্বরের পর জেনারেল জিয়া খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।বোস্টার লিখেছেন, ‘শুক্রবার সকালে জেনারেল জিয়া, মোশতাক এবং অন্যান্য প্রধান ব্যক্তিদের একটি বৈঠক হয়।এ বৈঠকেই মোশাররফ-পরবর্তী সরকারের চেহারা স্পষ্ট হয়।রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব মোশতাক ফিরিয়ে দেন। তিনি যুক্তি দেন, পরিস্থিতি এখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। দেশে এখন দরকার একজন অরাজনৈতিক ও অবিতর্কিত রাষ্ট্রপতি।এ প্রেক্ষাপটে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদে রাখা হয়।পরে তাকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।খালেদ মোশাররফকে হত্যার পর এবং সায়েমের শপথ গ্রহণের আগ পর্যন্ত এই দায়িত্ব জেনারেল জিয়া পালন করেছিলেন।আমাদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল, বিচারপতি সায়েমের রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিষয়টি সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে পূর্ণ সমর্থন লাভ করেছে।এর ফলে দেশের স্থিতিশীলতা পুনরুজ্জীবনের পথ সুগম হয়েছে।১০ নভেম্বর সোমবার সকাল পর্যন্ত পরিস্থিতি দৃশ্যত অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। রোববার আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল শুরু হলো।কিন্তু সাধারণভাবে একটা অশান্তি বজায় ছিল।কারণ, তখনো খবর আসছিল, সামরিক বাহিনীর মধ্যে খুনখারাবি চলছে।অন্যদিকে সীমান্তে ভারতীয় অভিযানের আশঙ্কা।সব মিলিয়ে বলা যায়, একটি অব্যাহত উত্তেজনা ও অনিশ্চিত অবস্থা।’ ঘটনার বিশ্লেষণের তারবার্তাটির শেষে বোস্টার স্পষ্ট অভিমত দেন।বোস্টার লেখেন, ‘এতক্ষণ ধরে যে আলোচনা করা হলো তা থেকে তিনটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়।প্রথমত, অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রধান অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন অরাজনৈতিক।কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু খালেদ মোশাররফ।তার একটু বাড়তি অসুবিধা ছিল যে তাকে ভারতপন্থি বলে মনে করা হতো।সেনাবাহিনীর যে অংশটি খন্দকার মোশতাকসহ মেজরদের উৎখাত করল, তাদের কিন্তু প্রাথমিক ক্ষোভের কারণ ছিল আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মেজররাই।৭ নভেম্বরে পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটিয়েছিল সেনাবাহিনীর নিচের পদের লোকেরা।যারা খালেদ মোশাররফের চেয়ে জিয়াকেই বেশি পছন্দ করছিল।কারণ, তারা মোশাররফের আনুগত্য কোথায় নিহিত, তা নিয়ে সন্দিহান ছিল।’ এ কথার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার একটি মন্তব্য করেন।আর তা হলো ‘গত সপ্তাহে বাংলাদেশে আমরা যতগুলো সরকার দেখেছি, চরিত্রগতভাবে তার কোনোটিই আমেরিকাবিরোধী, ভারতপন্থি কিংবা সোভিয়েতপন্থি ছিল না।দ্বিতীয় হলো, আমাদের কাছে এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে এ সপ্তাহের ঘটনাবলিতে ভারত দায়ী ছিল। তৃতীয়ত, এসব ঘটনাবলি এটাই নিশ্চিত করছে যে এই বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সমাজের নিম্নতম স্তর পর্যন্ত ভারতবিরোধী মনোভাব কত শক্তিশালী ও পরিব্যপ্ত।যদিও মোশাররফ যে ভারতপন্থি ছিলেন সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।কিন্তু তাকে ব্যাপকভাবে সেভাবেই দেখা হয়েছিল।এবং তাকে উৎখাতের ঘটনায় যে উল্লাস এখানে হয়েছে, তাতে ভারতবিরোধী মনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’ তারবার্তায় বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলির রাষ্ট্রদূত বোস্টারের চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিহত হবার পর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক বাহিনী তথা দেশের সর্বত্র এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হত্যা, অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনার মধ্যে সময় এগুতে থাকে। সর্বশেষ ৬ নভেম্বর দিবাগত ভোর রাতে বিপ্লবের প্রতিবিপ্লবে মাধ্যমে এর অবসান ঘটে। এখানে উল্লেখ্য, ৭৫-এর ৭ নভেম্বরে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে যে ঘটনা ঘটেছিল তার নায়ক বলে ধরা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লে, কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তমকে।পরবর্তীতে তাহেরকে গ্রেফতার হয় এবং তার বিরুদ্ধে আরেকটি পাল্টা বিপ্লব ঘটানোর ষড়যন্ত্র নেতৃত্ব দেয়ার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহীতায় অভিযুক্ত করা হয়। যা বাস্তবেও সত্য ছিল। পরে বিচারের (বিতর্কিত) রায়ে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল।হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব।ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী দল সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বন্দী করে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়।এ ঘটনা সাধারণ জনগণ ও সিপাহীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। মেজর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে, বিশেষত সিপাহীদের কাছে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়।ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘটে সিপাহী পাল্টা এক বিপ্লব, যা কারো মতে ইতিহাসে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে স্থান লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বিপ্লব সম্পর্কে বলা হয়, ‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে।মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন।’ ৭ নভেম্বর সম্পর্কে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে লেখেন, ‘১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র।একটি ব্যাপারে ডান ও বাম উভয় রাজনৈতিক দলই একমত ছিল, আর তা হচ্ছে খালেদ মোশাররফ একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের দালাল এবং সে ঘৃণিত বাকশাল ও মুজিববাদ ফিরিয়ে আনতে চাইছে।’ ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’ জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।ওইদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী।পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে।নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন তারা।আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাঙ্কের নলে পরিয়ে দেন ফুলের মালা।এই আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর-গ্রামেও পৌঁছে যায়।’ ঘটনাগুলো যেসব কারণে ঘটেছিল এর অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও অতিমাত্রায় ভিনদেশিদের তোষণনীতি।ফলে বলতে হয়, অতীতের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে আমাদের রাজনীতিবিদদের।অন্যথা এ ধরনের রক্তপাতের পুনরাবৃত্তির সুযোগ করে দিবে।আমরা চাই না স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। ফলে আমাদের সবাইকে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।সব ভেদাভেদ ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে দেশকে। সবশেষে, ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী ওই সময়টায় সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানে সেনানিবাসের বন্দিদশা থেকে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যদি মুক্ত না হতেন তাহলে জাতির ভাগ্যাকাশে কী ঘটতে পারতো তা কী আমরা একবার চিন্তা করেছি!কেননা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়ার মত একজন সাহসী নেতার নেতৃত্বেই পরবর্তীতে নস্যাৎ হয়েছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী সব ষড়যন্ত্র।আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তা না হলে হয়তো এতদিনে সিকিমের পরিণতি ভোগ করতে হতো আমাদেরও। তাই আজকের ‘জিয়া’ তোমাকে অনেক মনে পড়ে। লেখক: গবেষক ও কলামলেখক । ই-মেইল:[email protected] ৭ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে