রবিবার, ০৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৫৮:৪৩

জামিনে বেরিয়ে জঙ্গিরা আবার অপরাধে জড়াচ্ছে

জামিনে বেরিয়ে জঙ্গিরা আবার অপরাধে জড়াচ্ছে

নিউজ ডেস্ক: ২০০৫ সালে সারা দেশে একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা তরিকুল ইসলাম। দুই বছর আগে জামিনে ছাড়া পান তিনি। এরপর গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও কথিত পীর খিজির খানকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগে আবার গ্রেপ্তার হন তরিকুল। গত ২৫ অক্টোবর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি নিজ হাতে খিজির খানের গলা কাটার কথা স্বীকার করেন। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, শুধু তরিকুলই নন, গত পাঁচ বছরে জেএমবির ৪২ জন, হিযবুত তাহ্রীরের ৪২১ জন, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) ১৫ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের চারজনসহ ৪৮২ ব্যক্তি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জামিন পাওয়ার পর এসব জঙ্গি ও নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা আবারও হত্যা, নাশকতাসহ রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িয়েছেন। আদালত সূত্র জানিয়েছে, আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ও ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন বিচারিক আদালত এসব আসামির জামিনের আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এসব জামিন বাতিল চেয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপিল আবেদন করেনি। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ প্রভাবিত হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। জঙ্গিদের জামিন বাতিলের জন্য আপিল না করার ব্যাপারে ক্ষুব্ধ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘আমি যখনই জানতে পারি, তখনই ব্যবস্থা নিই। অধিকাংশ সময় পর্যন্ত এটি আমার কাছ পর্যন্ত আসে না। তবে এটা যাতে না হয়, সে জন্য আমি নজরদারি বাড়িয়েছি।’ জামিন পেয়ে আবার অপরাধে: ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি উত্তরায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। আসিফকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন সাদ আল নাহিন, কামাল হোসেন সর্দার, কাওছার হোসেন ও কামাল উদ্দিন নামে চারজন। এঁদের মধ্যে নাহিন বর্তমান শ্রম প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পার্টির নেতা মুজিবুল হকের ভাতিজা। চার আসামিই আসিফ মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে আহত করার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন। তাঁরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জবানবন্দিতে সাদ আল নাহিন বলেছেন, তিনি নিজে আসিফ মহিউদ্দীনকে ধারালো ছুরি দিয়ে ঘাড়ে কোপ দেন। তসলিমা নাসরিনসহ নাস্তিক-মুরতাদদের হত্যা করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় বলে জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পরেও ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই নাহিনকে জামিন দেন ঢাকার তৎকালীন মহানগর দায়রা জজ জহুরুল হক। নাহিনের জামিনদার ছিলেন তাঁর চাচা মুজিবুল হক। নাহিনের জামিনের মাত্র দুই দিন পর কাউছার ও কামাল উদ্দিনকে জামিন দেন ঢাকার মহানগর হাকিম এম এ সালাম। কয়েক দিনের ব্যবধানে কামালউদ্দিনও জামিন পান। গত ৭ আগস্ট খিলগাঁও পূর্ব গোড়ানের ভাড়া বাসায় ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় করা মামলায় সাদ আল নাহিন, কাওসার ও কামাল হোসেন সরদারকে আবারও গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। জেএমবির ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ও জামিনে: ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর গোপীবাগে এক কথিত পীরের বাসায় ঢুকে ছয়জনকে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় গত বছরের (২০১৪ সালের) ১৫ সেপ্টেম্বর জেএমবির গোলাম সারওয়ার ও মো. আজমীর নামে দুজনকে গ্রেপ্তার দেখায় ডিবি। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে ডিবির পরিদর্শক মো. আবুয়াল খায়ের মাতুব্বর দাবি করেছেন, গোলাম সারওয়ার জেএমবির ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’, এরা ছয় হত্যায় জড়িত। এরপর চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল আজমীর এবং ১৪ জুন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড গোলাম সারওয়ার হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। এই জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও কোনো আপিল করেনি বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। বিচারিক আদালতে সারওয়ার ৩০ জুন এবং আজমীর ১৮ মে জামিননামা দাখিল করেছেন। জামিনে বেরিয়ে ব্লগার হত্যা: ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান (বাবু)কে গত ৩০ মার্চ তেজগাঁও শিল্প এলাকার দক্ষিণ বেগুনবাড়ীতে রাস্তার ওপর কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে হিজড়াদের সহযোগিতায় পুলিশ জিকরুল্লাহ ও মো. আরিফুল ইসলাম নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে আরিফুল ইসলাম নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওয়াশিকুর হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহ মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘আরিফুল রায়পুরা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে তিনি আদালত থেকে জামিন পেয়ে বের হয়ে আবারও জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। ব্লগার ওয়াশিকুরকে নিজে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন আরিফুলসহ অন্যরা।’ পরে আরিফুলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি। দলে দলে জামিনে হিযবুত সদস্যরা: সরকার নিষিদ্ধ করলেও বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া হিযবুত তাহ্রীরের সদস্যরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন। যেমন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলায় গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন মো. আসিফ আদনান ও মো. ফজলে এলাহি। ওই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেই গত বছরের ডিসেম্বর মাসে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান আসিফ আদনান। আর ফজলে এলাহীও হাইকোর্ট গত মার্চ মাসে থেকে জামিন পান। জামিননামা দাখিল করা হয়েছে ৩ মার্চ। চলতি বছরের ৪ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) আসলাম আলী শেখ। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘আদনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হিযবুত তাহ্রীরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। পরে তিনি নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। হিযবুত তাহ্রীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।’ আরও দেখা গেছে, ২০১২ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা কলাবাগান থানার ১২(৮)১২ মামলার আসামির সংখ্যা ৩৫। তাঁরা সবাই হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য এবং গ্রেপ্তারের কয়েক মাসের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন অপর একটি মামলার নথিতে দেখা যায়, ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন হিযবুত তাহ্রীরের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা গোলাম মাওলা ও মাকসুদুর রহমান। ১ ডিসেম্বর গোলাম মাওলাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ১২ ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান সৈয়দ গোলাম মাওলা। দায় কার: এসব আসামির জামিন পাওয়া এবং এর বিরুদ্ধে আপিল না করার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘জামিন শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখে। জঙ্গিদের জামিন হলেও অনেক সময় তা আমার নজরে আনেন না সরকারি কৌঁসুলিরা।’ উচ্চ আদালত ও বিচারিক আদালত থেকে জঙ্গিদের জামিন প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, জামিনে গিয়ে জঙ্গিরা খুনখারাবিসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, এমন তথ্য হাইকোর্টের কাছে আইন কর্মকর্তাদের তুলে ধরা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা জনগণের নিরাপত্তার পরিবর্তে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি। দেখা যাচ্ছে, জঙ্গি সংগঠনের দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জামিন পাওয়ার পর সরকার আর উচ্চ আদালতে জামিন বাতিলের জন্য যায় না। অথচ জামিনে ছাড়া পেয়ে জঙ্গিরা আবারও বীভত্স কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে।-প্রথম আলো ০৮ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে