মহিউদ্দিন অদুল : ইসরাত-ই-আলম এশা (১৫), স্বজন মাহমুদ (২৪) ও শতাব্দী বর্মণ (২২)। তিনজনই আত্মহত্যা করেছেন একই কায়দায়। গলায় ফাঁস। এখানেই শেষ নয়- তিনজনই মৃত্যুর আগে করেছেন একই ধরনের আচরণ, যা মিলে যায় ব্লু হোয়েল আসক্তির সঙ্গে।
তবে সেন্ট্রাল রোডের কিশোরী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার আত্মহত্যা ঘটনার আগে ব্লু হোয়েলের বিষয়টি চাউর না হওয়ায় সন্দেহ জাগেনি তিন তরুণের স্বজনদের।
ইশরাত-ই-আলম এশাও ছিলেন মেধাবী ছাত্রী। পড়তেন রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজে। দশম শ্রেণিতে। বিজ্ঞান বিভাগে। জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। তাই দু’বছর আগে তার পিতা রংপুর শহরের ব্যবসায়ী শামসুল আলম এবং মা এডভোকেট নার্গিস মোর্শেদা মুন্নি একমাত্র কন্যাকে কম্পিউটার কিনে দেন।
তাতে ইন্টারনেট সংযোগও দেয়া হয়। একই সময় থেকে তাকে দেয়া হয় এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। এরপর থেকে এশা প্রায়ই মোবাইল ও কম্পিউটারের গেমসে ডুবে থাকতো। গত জানুয়ারি মাস থেকে বদলাতে থাকে তার আচার-আচরণ। তবে আত্মহত্যার আগ পর্যন্ত এসবে তেমন আমল দেননি তার বাবা-মা। গত ২৫শে মার্চ রাতে নিজের কক্ষে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এশা। লিখে রেখে যায় একটি চিরকুট। তাতে হাসির চিহ্ন আঁকা।
সম্প্রতি ব্লু হোয়েলে একাধিক আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা পত্রপত্রিকায় আসায় এশার আত্মহত্যা ও তার আগের নানা আচরণ ওই গেইমারদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বলে জানান এশার বাবা-মা।
এশার মা নার্গিস মোর্শেদা মুন্নি বলেন, সে খুব মেধাবী ছিল। জানুয়ারি থেকে তার আচরণ বদলে যেতে থাকে। আমাকে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে। মৃত্যুর পনের দিন আগে সে তাকে রেডিয়ামের কঙ্কাল কিনে দিতে আমাকে বাধ্য করে। সে গেমের ২০ বা ২৫ ধাপে যাওয়ার কথা বলতো। একদিন গভীর রাতে বলে যে, দেখ আমি সাহসী। এখনই বাইরে গিয়ে আমপাতা এনে দিতে পারবো। এই বলেই সে দৌড়ে বেরিয়ে ছাদে গিয়ে আমগাছের পাতা ছিঁড়ে আনে।
এশার মা বলেন, মাঝে-মধ্যে সে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ছাদের খোলা অংশের কার্নিশ দিয়ে হাঁটতো। বকলেও শুনতো না। তার কক্ষে গেলে বিরক্তি প্রকাশ করতো। এমনিতে খুব একটা টেলিভিশন দেখতো না। কিন্তু ভূতের সিরিয়াল বা সিনেমা থাকলে তা মিস করতো না। একইভাবে নিজের ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনে ভূতের ছবি দেখতো। তার মোবাইলের হেড ফোন আমার কানে ঢুকিয়ে দিয়ে ভূতের গল্প শোনাতো। প্রায় সময় বলতো, আমার কিছুই ভালো লাগে না। ফেসবুকে আর একটা আইডি ছিল ‘প্রেতাত্ম’ নামে।
তিনি বলেন, তার অন্য বন্ধুদের ফেসবুক আইডিও ছিল প্রায় কাছাকাছি নামের। কারোটা অশরীরী, অশরীরী আত্মা, কানকাটা কাউয়া ইত্যাদি। সে আত্মঘাতী হওয়ার পর সেই আইডিগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়। ইন্টারনেটে গেমে ডুবে থাকা নিয়ে আমি বকলে সে বলতো, ইন্টারনেটে গেম খেলায় যে কী মজা; তা তুমি কীভাবে বুঝবে?
এশার পিতা শামসুল আলম বলেন, আমার মেয়ে জেএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ার পর সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়ায় ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন কিনে দিই। আত্মহত্যার পর তার ল্যাপটপে ব্লু হোয়েল গেমের উদ্ভাবক বলে পরিচিতি পাওয়া ফিলিপ বুদেকিনের ছবি ও সে সম্পর্কে বেশকিছু লেখা পাওয়া গেছে। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে আমরা এসব কিছু ধারণাই করতে পারিনি। এখন সন্দেহ হচ্ছে আমার মেয়েও হয়তো ব্লু হোয়েলের শিকার।
একইভাগে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বি-ব্লকের এক মেসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন স্বজন মাহমুদ (২৪)। তিনি নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ১১ সেমিস্টারে পড়তেন। একই সঙ্গে এই মেধাবী তরুণ তার বিষয়ে ইন্সট্রাক্টর হিসেবেও কাজ করতেন। তার বাড়ি ঝালকাঠিতে।
এক সময় তিনি শিশু সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন। আত্মঘাতী হওয়ার পর তার মোবাইল ও কম্পিউটার জব্দ করেছে পুলিশ। কিন্তু তার মোবাইল ও কম্পিউটার নিজের আই কন্টাকের পাসওয়ার্ডে লক করায় এখনও তাতে কী আছে তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তার বন্ধুদের ধারণা সেও ব্লু হোয়েলের শিকার।
স্বজন মাহমুদের পিতা আইনজীবী আবদুল জলিল বলেন, আমার ছেলে কম্পিউটার প্রযুক্তিতে খুবই মেধাবী ছিল বলে জানিয়েছেন তার শিক্ষকরা। কী কারণে সে আত্মঘাতী হতে পারে- এমন কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে তার আত্মহত্যার ধরন ও কিছু আচরণ ব্লু হোয়েলের সঙ্গে মিলছে।
এর আগে গত ১২ই সেপ্টেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন শতাব্দী বর্মণ নামে বাইশ বছরের আরেক তরুণী। রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা এলাকার ৭৬/২/ই/২৬ নম্বর বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন। -এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি