নিউজ ডেস্ক : কলকাতার লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. গার্গা চ্যাটার্জি ভারতীয় দৈনিক ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় জাতীয় সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচিতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি মনে করেন, দেশটির অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিবেচনায় শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচিতির উল্লেখ এড়াতে পারতেন।
উল্লেখ্য হার্ভাড থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ড. গার্গা কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করছেন। ২০শে অক্টোবর তিনি তার ওই নিবন্ধে লিখেছেন, ভারতের বিজেপি সরকার রোহিঙ্গা প্রশ্নে যে নীতি অনুসরণ করছে তাতে ‘হিন্দু হিন্দু হিন্দুস্তান’ মতাদর্শগত নীতির প্রতিফলন রয়েছে।
এটা হলো স্নায়ুযুদ্ধ যুগের অবসান পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থার রুঢ় বাস্তবতা। যেখানে বহুমাত্রিক বিশ্বব্যবস্থার কোনো সুলক্ষণই চোখে পড়ে না। ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ে কিছুটা বলাবলি হলেও বাস্তবে তার কোনো ছাপ নেই।
মি. গার্গা লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সব সীমাবদ্ধতা নিয়েও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি রক্ষাকবচ ছিল। এর ফলে কোনো একটি পক্ষ যখন দুষ্কৃতকারীর পক্ষ নিতো তখন অন্য পক্ষ নিতো ভুক্তভোগীর পক্ষ। এখন সেই আবেদন চুকে বুকে গেছে। তার মতে বৈশ্বিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।
তার ভাষায়, যে যার স্বার্থ দেখছে, সুতরাং রোহিঙ্গাদের পাশে কেউ নেই। চীন মিয়ানমারে খনিজ সন্ধান করছে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চলাচল বাদ দিয়ে চীন এখন মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে তাদের বসানো পাইপলাইন দিয়ে দ্রুত তেল আমদানি করতে পারছে।
মি. গার্গির মতে, ভারত মিয়ানমারে বড় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য ‘মেকআপ গেম’ খেলছে। ভারতের বিগ বিজনেস হাউসগুলো বড় প্রকল্প পেতে চান সেখানে। আর বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বিজেপিকে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এনেছে। সুতরাং ১০ লাখ রোহিঙ্গার দিকে কে তাকাবে? যখন তারা দরিদ্র এবং দেয়ার মতো কিছুই তাদের কাছে নেই।
ওই নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত দরিদ্র রাষ্ট্র তাকেই কিনা রোহিঙ্গাদের ধারণ করতে হলো, এটি ঘনবসতিপূর্ণ এমন একটি ভূখ- যেখানে মানুষ উপচে পড়ছে। আর যখনই রোহিঙ্গা ইস্যু ছড়িয়ে পড়লো, তখনই প্যান-ইসলামপন্থিরা তাদের কার্ড নিয়ে খেলতে নেমে পড়লো। তাদের সামনে প্রশ্ন হলো রোহিঙ্গা মুসলমানরা কি মানুষ নয়?
তাদের এই মুসলিম পরিচিতির জোর এতটাই প্রবল যে, বাংলাদেশের সংসদে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গারা মুসলমান। অধিকাংশ রোহিঙ্গাই মুসলমান। কিন্তু সকল রোঙ্গিঙ্গাই মুসলমান নয়। উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনেকে হিন্দু রোহিঙ্গা আছে।
বাংলাদেশের টিভি মিডিয়ায় এই খবর এসেছে যে, হিন্দু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা রোহিঙ্গা শিবিরে সম্ভ্রমহানীর শিকার হয়েছেন। উপরন্তু বিবিসি একটি গণকবর দেখিয়েছে যেখানে অধিকাংশ নারীর মরদেহ পাওয়া গেছে। যদিও এর সত্যতা কোনো নিরপেক্ষ সূত্রে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, এটা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কাজ।
গার্গি এরপর লিখেছেন, উপমহাদেশের বাস্তবতা কল্পনার চেয়ে অনেক কঠিন। উপমহাদেশে অনেক মুসলমান মনে করেন হিন্দুরা হলো সব থেকে খারাপ মানুষ, আর অনেক হিন্দু মনে করেন সব থেকে খারাপ হলো মুসলমান। আর ঠিক এরকম একটি সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি মুসলিম ইস্যু হিসেবে নাজিল হয়েছে, যেখানে তুরস্কের অধিপতি এরদোগান নব্য দয়ালু সুলেমান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
নিবন্ধে অবশ্য বলা হয়, কিন্তু এটা অবশ্যই একজনকে বুঝতে হবে যে, কেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মুসলিম কার্ডকে খেলতে হলো। তার কারণ তার প্রতিপক্ষ তাকে সবসময় এই সমালোচনা করে থাকে যে তিনি ও তার দল সংখ্যালঘুদের কান্ডারি। ইসলামবাদীরা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা বিষয়টিকে এমনভাবে মোকাবিলা করছে যে, তারা একটি নতুন মওকা পেয়েছে।
তবে সরকারিভাবে একটি কৌশলগত বাঙালি জাতীয়তাবাদী লাইনও বেশ পরিষ্কার। সেটা হলো ত্রাণ শিবিরগুলোতে সরকারিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ চলছে। কারণ স্থানীয়রা ভয়ে আছে যে, তাদের চেয়ে রোহিঙ্গাদের জন্মহার বেশি। পরে না আবার তারাই নিজ এলাকায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।
ইসলামন্থিরা ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা মনে করার কারণ নেই যে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরে যেসব শ্বেতাঙ্গ সাহায্য পৌঁছেছে, তার সাহায্যদাতাদের মনে কোনো কুসংস্কার নেই। আবার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্মী বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে।
তাই রোহিঙ্গা মুসলমান মারার বদলা হিসেবে বাংলাদেশি বৌদ্ধদের ওপর হামলাও চলেছে। সেকারণেই বলি তার দেশের এধরনের জটিল সমীকরণ বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাদের মুসলিম পরিচয় তিনি এড়াতে পারতেন।
মি. গার্গি আরো লিখেন, অন্যদিকে তথাকথিত সুন্নি উম্মা আবার বাদামি রঙের মানুষদের সমঅধিকার সম্পন্ন মানুষ বলেই হিসেবে ধরে না। দুই পবিত্র মসজিদের গার্ডিয়ান এখন ইয়েমেনকে ধ্বংস করতে ব্যস্ত। তারা পলায়নপর রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর অবকাশ পায়নি।
চীন মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রোহিঙ্গাদের দুঃখকষ্টে বিচলিত নয়। ভারত যদিও বাংলাদেশে প্রতীকী সাহায্য পাঠিয়েছে, কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করা হয়েছে।
এমটিনিউজ/এসএস