বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:৪৯:১৩

শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নারীদের অনৈতিক ব্যবসা

শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নারীদের অনৈতিক ব্যবসা

নিউজ ডেস্ক : অনৈতিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা যুবতী, নারীরা। ১৯৯২ সালে স্থাপিত আশ্রয় শিবিরে আগে থেকেই অবস্থান করছেন এমন কমপক্ষে ৫০০ রোহিঙ্গা যুবতী এ ব্যবসায় জড়িয়ে গেছেন বলে দাবি করেছেন তাদের দালাল নূর।

এর সঙ্গে নতুন করে যারা আশ্রয় নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাদের দিকেও লোলুপ দৃষ্টি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের। তারা যুবতীদের অনৈতিক ব্যবসায় প্রলুব্ধ করছে। এমন সব নারীর খদ্দের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনীতিক পর্যন্ত। তারা অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।

তারা বাংলাদেশি খদ্দের। ফলে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপচেপড়া আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা নারীরা যখন খাদ্য, পানিসহ মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য মরণপণ লড়াই করছেন তখন সেখানে নগদ অর্থের লোভ দেখানো হচ্ছে তাদেরকে অনৈতিক ব্যবসায় যোগ দিতে।

এমনই একটি ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, মাটির পরিচ্ছন্ন একটি ঘর। তার মাঝে প্রবেশ করলেন চারজন নারী। তাদের শরীরে জড়ানো কালো চাদর সরিয়ে নিলেন। পা ক্রস করে দিয়ে বসলেন মেঝেতে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হলো, তারা অর্থের বিনিময়ে শরীর বিক্রি করেন কিনা।

এ প্রশ্নে তাদেরকে অস্বস্তিতে দেখা গেল। তারা নীরব হয়ে গেলেন। চা পানের পর আবার প্রশ্নোত্তর শুরু হলো। ওই যুবতীরা একে-অন্যের চোখের দিকে তাকাতে লাগলেন। ধীর পায়ে তাদের একজন ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলেন দরজা বন্ধ করতে। আরেকজন জানালা বন্ধ করলেন। ছোট্ট, স্যাঁতসেঁতে ঘরে অন্ধকার নেমে এলো।

এর মাঝেই ফিসফিসে গলায় কথা চলতে লাগলো। ২৬ বছর বয়সী রমিজা বললেন, যদি কেউ আমাদেরকে এখানে দেখতে পায় তাহলে মেরে ফেলবে। উল্লেখ্য, ২৫শে আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর রাখাইন থেকে কমপক্ষে ছয় লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল কক্সবাজার পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা শরণার্থী শিবির।

এর মধ্যে কুতুপালং হলো সবচেয়ে বড় আশ্রয়শিবির। সেখানে অনৈতিক ব্যবসার দ্রুত বিস্তার ঘটছে। এতে যারা জড়িত তারা অনেক আগে থেকেই এখানে আছে। তার ওপর নতুন করে হাজার হাজার যুবতী, নারী আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। ফলে এ ব্যবসা সেখানে বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া রমিজা বলেন, এ ব্যবসার যারা হর্তাকর্তা তারা নতুন আসা যুবতীদের দিকে নজর দিয়েছে। তাদেরকে এ ব্যবসায় নিয়োগ করার চেষ্টা করছে। তবে কতজন যুবতী বা নারী এ ব্যবসায় এ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছেন সে হিসাব নেই জাতিসংঘে কোনো এজেন্সির কাছে।

ইউএনএফপিএ’র বিশেষজ্ঞ সাবা জারিফ বলেন, সংখ্যায় তাদের কতজন এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে তা বলা কঠিন। এ সব আশ্রয় শিবিরে কতজন আছেন সে বিষয়ে আমরা এখনো ডাটা সংগ্রহ করিনি। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলেছে, বিশৃঙ্খল, এলামোলো ক্যাম্পগুলোতে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়তে পারে শিশু ও যুবক, যুবতীরা। তাদেরকে বিপথে পরিচালনা করা হতে পারে।

দালাল নূর তাই বলে দিয়েছেন ভিতরের কথা। তিনি বলেছেন, বাইরে থেকে মানুষ মনে করবে এখানে এমন কোনো ব্যবসা হয় না। কারণ, আশ্রয় শিবিরের বাইরে খদ্দেরের সঙ্গে মিলিত হন যুবতীরা। তারা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের কারো সঙ্গে শয্যাসঙ্গীনি হন না। এর মধ্য দিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে তারা নিজেদেরকে ‘পিওর’ হিসেবে দেখাতে চান।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনৈতিক ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছে যারা তার বেশির ভাগই টিনেজ। দিনে তারা একবারের বেশি খাবার পায় না। স্কুলে যায় না। তারা এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে গোপনে, তাদের পিতামাতারও অজ্ঞাতে। এমনই একজন কিশোরী রিনা (১৮)। গত এক দশক ধরে তিনি বসবাস করছেন এই আশ্রয়শিবিরে।

দু’বছর আগে তাকে মাদকাসক্ত এক ব্যক্তিকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে। রিনা এ সম্পর্কে বলেন, স্বামী আমার সঙ্গে ভীষণ খারাপ আচরণ করেন। প্রহার করেন। প্রথম ছেলে জন্ম হওয়ার পর তিনি আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এখন ওই সন্তানের ভরণ-পোষণ আমার কাছে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই আমি এই অনৈতিক পথ বেছে নিয়েছি।

তিনি বলেন, ১৬ বছর বয়সে আমি এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি। তখন আমার অর্থের খুব দরকার হয়ে পড়ে। আরেকজন যৌনকর্মী ১৪ বছর বয়সী কমরু। কয়েক বছর আগে তিনি পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে। কমরু বলেছে, আমার স্মৃতিতে এই আশ্রয়শিবির ছাড়া কিছু নেই। এখানেই বড় হয়েছি। সব সময়ই আমাকে ক্ষুধার্ত থাকতে হয়। নিজের পুরো নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

অনৈতিক ব্যবসায় যারা জড়িয়ে পড়ছেন তাদের সবারই কাহিনী অভিন্ন। তা হলো দারিদ্র্য, পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন, অর্থের অভাব। তাই তারা ফাঁদে পড়ে পা বাড়িয়েছেন অনৈতিক বাণিজ্যে।

রেডক্রসের জেন্ডার প্রটেকশন স্পেশালিস্ট লিসা আকিরো বলেছেন, যদি সাহায্য বিষয়ক এজেন্সিগুলো এসব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে পাচার ও অন্যান্য অপরাধের মাত্রা বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে রমিজার কথাই উল্লেখ করা যাক। তিনি ক্ষুধার্ত ছিলেন। পুষ্টিহীনতায় ভুগছিলেন। তাই বেঁচে থাকার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন অনৈতিক পথ।

রমিজা বলেছেন, ওই পরিস্থিতিতে যে কোনো কিছু করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। কি করবো সে বিষয়ে কোনো বাছবিচার ছিল না। এমন অবস্থায় তাকে প্রথমে একজন শারীরিক সমপর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এক হাজার টাকার বিনিময়ে রমিজা তাতে রাজি হয়ে যান।

রমিজা বলেন, ওই খদ্দের আমাকে ভালো অর্থ দিয়েছেন। এখন প্রতিজনের কাছ থেকে তিনি ২০০ টাকা নেন। এর অর্ধেক পায় তার দালাল। এ ব্যবসার বেশির ভাগ চালানো হয় ফোনকলের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে তাদেরকে বলে দেয়া হয় কোথায় যেতে হবে, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। গড়ে প্রতি সপ্তাহে তিনজন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হয় রমিজাকে।

বেশি খদ্দের ধরলে তাতে ব্যবসার খবর ফাঁস হয়ে যাবে এ ভয়ে তিনি বেশি সাহস পান না। তার ভাষায়, মাঝে-মধ্যে এজন্য আমাকে কক্সবাজার শহরে যেতে হয়। দু’ঘণ্টার সফরে পৌঁছে যাই সেখানে। যখন আমি আশ্রয়শিবির ছেড়ে যাই তখন আমাকে কোনো না কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে হয়।

বলতে হয়, আমি হয়তো কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চলেছি। এভাবেই পর্দার আড়ালে পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হয়। তাদের খদ্দেরের তালিকায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনীতিক। এ নিয়ে ফোনে কথা হয় ২৩ বছর বয়সী বাংলাদেশি একজন ছাত্র আলীর সঙ্গে।

তিনি জানিয়েছেন, মাঝে-মধ্যেই তিনি তাদের সঙ্গ ভোগ করেন। তবে তিনি চান, যাকে বিয়ে করবেন তিনি যেন একজন কুমারী হন। এ ব্যবসায় জড়িত রোহিঙ্গা নারীরা বলেছেন, বেশির ভাগ খদ্দেরই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার সময় নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার করে না।

তাই রমিজা বলেন, আমাকে জন্মবিরতিকরণ ইঞ্জেকশন নিতে হয়। কারণ, প্রতিদিনই ভয় হয় যদি এইচআইভি’তে আক্রান্ত হই। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছি কিনা সেই পরীক্ষা করানো হয়নি।

প্রায় দেগ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে স্থানীয় দাতব্য সংস্থা পালস স্থাপন করেছে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য নিরাপদ একটি স্থান। সেখানে একসঙ্গে ৩০ জন নারীকে স্থান দেয়া যায়। কয়েক দিনের মধ্যে এটি খুলে দেয়ার কথা। এটি সুসজ্জিত ও ডরমিটরি ধরনের। এখানে মনোবিজ্ঞান বিষয়ক শাখা আছে।

এই আশ্রয় শিবিরের ম্যানেজার খুরশিদা আখতার বলেন, এখানে যেসব নারী আসেন তারা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সব কথা বলতে চান না। তাদের ভয় তারা তাতে বিপদের মুখে পড়তে পারেন। এখানে বিপন্ন নারীদেরকে স্বাগত জানানো হয়, যারা সম্ভ্রমহানী শিকার হয়েছেন। সঙ্গে মা অথবা অনৈতিক পেশার কর্মী।

খুরশিদা আখতার আরো বলেন, এসব নারীর জীবনকে আমরা নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে চাই। তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে চাই। তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে ও কাজের বা চাকরির জন্য প্রশিক্ষণ দিতে চাই। তবে তাদের এ উদ্যোগের বিষয়ে এখনও অনেক নারী জানেন না।

কমরু রয়টার্সের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার পর যে ঘরে আলোচনা চলছিল সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। কালো বোরকায় নিজেকে ঢেকে নিলেন। ঢেকে নিলেন তার চোখ বাদে পুরো শরীর। যাওয়ার আগে বলছেন, এই পোশাক শুধু আমার খদ্দেরদের সামনেই খুলি। আমাদের শিবিরে আমি অচেনা একজন রোহিঙ্গা নারী হিসেবে থাকতে চাই। -এমজমিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে