বিশেষ প্রতিনিধি : রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা চলছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দিল্লি কী চায় বাংলাদেশে। শুধু রাজধানী নয়, মাঠপর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে ভারতের অবস্থান নিয়ে।
অনেকেই চায়ের টেবিলে ঝড় তোলেন ১৯৭১ সালের পরীক্ষিত বন্ধু ভারত এখন কোন পথে? নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে।
সর্বশেষ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক নিয়েও রাজনৈতিক মহল বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভোটের হিসাব ও জোটের হিসাবে জড়াবে না ভারত। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে ভারত। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দায়িত্ব সরকারের। নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে তাও নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ।
এখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলাবে না তারা। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক প্রথমে চূড়ান্ত ছিল না। বিএনপিকে বিলম্ব করে জানানো হয়।
বিএনপি চেয়েছিল তাদের দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অথবা বাসভবনে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়ে সাক্ষাৎ করুক। এই প্রস্তাব প্রথমে নাকচ করে দেওয়া হয় ভারতীয় কূটনৈতিক মহল থেকে। বিএনপি চেয়ারপারসন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার পর থেকেই এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয় বিএনপির সঙ্গে ভারতের।
ক্ষমতায় থাকার সময় চট্টগ্রামে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্রের ট্রাক আটককে ঘিরে যে সমস্যা ছিল বেগম খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের সময় তা কমে আসে। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সে সময় দেখা না করাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সমস্যা এখনো বহাল রয়েছে। তবে সুষমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি কিছুটা স্বস্তি এনেছে নিজেদের মধ্যে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ধারণা ছিল, নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন্ধুত্বের সম্পর্ক কমে আসতে পারে। দূরত্ব বাড়তে পারে নতুন করে। কারণ কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঐতিহাসিক। কিন্তু সব কিছুকে উড়িয়ে দিয়ে বর্তমানে বিজেপি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় রয়েছে।
সর্বশেষ ঢাকা সফরকালে সুষমা স্বরাজ আলাদা করে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সুষমা যখন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা তখন বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতা। সুষমার আমন্ত্রণে তার বাড়িতে সে সময় শেখ হাসিনা এক মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিয়েছিলেন। নিজে মার্কেটে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে শাড়ি কিনেছিলেন সুষমা। সেই বন্ধন আগের মতোই রয়েছে।
দিল্লির সূত্রগুলোর মতে, সাউথ ব্লক কোনোভাবেই বাংলাদেশে আর জঙ্গিবাদের উত্থান দেখতে চায় না। পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্য রাখা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও ইতিবাচক সম্পর্কের বিপক্ষে তারা। বাংলাদেশের ভূখণ্ড কোনোভাবে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গ্রুপ ব্যবহার করুক তাও তারা চায় না।
দিল্লি চায় ঢাকার সঙ্গে ইতিবাচক কূটনৈতিক সম্পর্ক। সুষমা তার ঢাকা সফরকালে তাদের হাইকমিশনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ। এ সম্পর্ক এখন শুধু প্রতিবেশীর পর্যায়ে নেই, আন্তরিকতা থেকে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ডাকেন দাদা আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে ডাকেন দিদি।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো বিতর্কে জড়াবে না। তবে গভীর সুসম্পর্ক ধরে রাখতে সহায়তার হাত অব্যাহত রাখবে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এবারকার সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চতুর্থ জেসিসি বৈঠক শেষে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
একটি সই হয় ভারতের এইচএমটি ও বাংলাদেশের খুলনা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মধ্যে। অন্য সমঝোতা স্মারকটি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মধ্যে গ্যাসোলিন বিক্রিসংক্রান্ত। পরে বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলের আওতায় বিআইডব্লিউটিএকে ১০ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করে ভারত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক স্মারক ও দলিল হস্তান্তর করেন। যার মধ্যে রয়েছে ১টি এমআই৪ হেলিকপ্টার, ২টি পিটি৭৬ ট্যাঙ্ক, ২৫টি সমরাস্ত্র, অরিজিনাল সারেন্ডার সার্টিফিকেটের কালার কপি, রিফিউজি রিলিফের অরিজিনাল পোস্টাল স্ট্যাম্প, অরিজিনাল রিফিউজি রিলিফের পোস্টাল স্টেশনারি।
রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বিতরণের জন্য বিমান থেকে ফেলা লিফলেট, ইন্ডিয়ান আর্মি ইউনিটের ওয়ার ডায়েরির কপি, ইন্ডিয়ান আর্মির অ্যাকশন রিপোর্টের কপি, যুদ্ধকালীন মানচিত্রের সফট ও হার্ড কপি, আর্কাইভাল অডিও ক্লিপিংস অ্যান্ড রেকর্ডিংয়ের কপি, যুদ্ধের আলোকচিত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রামাণ্যচিত্র, ইন্ডিয়ান আর্মির যুদ্ধের ভিডিও ক্লিপিংস, বই, যুদ্ধকালীন ভারতীয় সংবাদপত্রের ক্লিপিংস, জেলাওয়ারি রিফিউজি ক্যাম্পের তালিকা প্রভৃতি।
এর আগে ৪ অক্টোবর অরুণ জেটলির সফরে তৃতীয় ‘ডলার ক্রেডিট লাইন অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর আওতায় বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা) ঋণ দেওয়ার চুক্তিবদ্ধ হয় ভারত। এটি হবে রাষ্ট্র হিসেবে অন্য কোনো দেশকে ভারতের সর্বোচ্চ ঋণ সহায়তা। এর আগেও এলওসির আওতায় দুবার ঋণ দিয়েছে ভারত।
২০১০ সালে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রথম ‘ডলার ক্রেডিট লাইন অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নমনীয় ঋণ সহায়তার জন্য দ্বিতীয় ‘ডলার ক্রেডিট লাইন অ্যাগ্রিমেন্ট’ ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে প্রথমটির অর্থে নেওয়া ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১২টির কাজ শেষ হয়েছে এবং দ্বিতীয়টির ১৪টি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের এই সম্পর্কের জায়গাটুকু আগামীতে কোন দিকে মোড় নেবে তা স্পষ্ট হবে সামনের দিনগুলোয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, উভয় দেশের জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান দেখতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে জোর দেবে ভারত। সেভাবেই ভারতীয় কূটনীতিকরা কাজ করছেন। -বিডি প্রতিদিন
এমটিনিউজ/এসবি