শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১১:৪৬:১২

একদল মুখোশধারীর হামলা, অতঃপর...

একদল মুখোশধারীর হামলা, অতঃপর...

নিউজ ডেস্ক : পথের ধারেই চোখে পড়বে দুটি সাইন বোর্ড। তার একটিতে লেখা—‘মিয়ানমার থেকে আগত অসহায় হিন্দু শরণার্থীর অস্থায়ী আশ্রয়।’

ইট বিছানো পথ ধরে সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে হরি মন্দির আর লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন এলাকা। সেখানে মুরগির একটি খামারে বাস করছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পশ্চিম হিন্দুপাড়া। চারদিকে সবুজ গাছপালা দিয়ে ঢাকা গ্রামটি ছবির মতো।

গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, ছোট একটি জায়গায় ঠাসাঠাসি করে বাস করছেন হিন্দু নারী-পুরুষ-শিশু। তারা রাখাইনের মংডুর ফকিরাবাজার, চিকনছড়ি ও আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা। মূলত স্বর্ণালংকার তৈরি ও মাটি দিয়ে বাসনকোসন তৈরির কাজ করে ভালোই চলছিল তাদের জীবন। হঠাৎ তাদের বাড়িঘরে হামলা চালায় একদল মুখোশধারী। কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে গিয়ে তারা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। অস্থায়ীভাবে আশ্রয় মেলে উখিয়ার কুতুপালংয়ের হিন্দু পাড়ার মুরগির একটি খামারে।

মুরগির খামারে ঢুকলেই চোখে পড়বে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস। একপাশে শিশুরা হইচই করছে। কেউবা আবার মোবাইলে হিন্দি গান শুনছে। কেউ ত্রাণসামগ্রী ভাগাভাগি করছে। মধ্যবয়সী এক নারী নিরালায় বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। হয়তো পেছনে ফেলে আসা কোনো ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি ভাসছে।

আরেক নারী পদ্মা বালা শীল। ঝুপড়ির মধ্যে কোনোরকমে সন্তানদের নিয়ে আছেন তিনি। মিয়ানমারের বলী বাজার থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বামী রয়ে গেছেন মিয়ানমারে। এক সপ্তাহ আগে এই ক্যাম্পে তাঁর একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। তিনি যে ঘরটিতে থাকেন তার ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম, ফুটফুটে শিশুটি মেঝেতে শুয়ে আছে। কাঁথা দিয়ে শরীর ঢাকা।

আর এক পাশে মা তারঁ হাতে একটা কার্টুনের খোসা দিয়ে সন্তানকে বাতাস করছেন। আমরা কিছুক্ষণ শুধু নীরবে মা আর তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই চরম দুর্দিনেও কতটা মমতা দিয়ে সন্তানের যত্ন নিচ্ছেন এই মা। আসলে মায়েরা এমনই হয়। আর নাফ নদীর ওপারে থাকা শিশুটির বাবা নিশ্চয়ই নিজের সন্তানের মুখটি একঝলক দেখার জন্য কতই না ছটফট করছেন। আহ্, কী জীবন!

পদ্মা বালা জানান, সদ্য জন্ম নেওয়া এই মেয়েকে নিয়ে তিনি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে বাস করতে চান সেই চিরচেনা আপন ঠিকানায়। এই দুর্বিষহ জীবন থেকে বাঁচতে চান। আমার সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আরও একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার কথা বললাম, স্থানীয় বাসিন্দা বাবুল শর্মার সঙ্গে।

তিনি পশ্চিম হিন্দুপাড়ার হরিমন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি এই মুরগির খামারের মালিক। বাবুল শর্মা বলেন, গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে মিয়ানমার থেকে হিন্দুরা পালিয়ে আসলে মানবতার কথা ভেবে তাদের এই মুরগির খামারে আশ্রয় দেওয়া হয়। এখানে অন্তত ১০৮টি পরিবারের ৪৩৯ জন বসবাস করছে।

এই শরণার্থীশিবিরে কম-বেশি সবাই প্রতিদিন দুই বেলা খেতে পারে। সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আশ্রয় নেওয়া এসব হিন্দু রোহিঙ্গাদের খাবারের ব্যবস্থা করছে। যারা খাবার রান্না করে তারাও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

তাদের একজন বিজয় রাম পাল। মিয়ানমারের চিকনছড়ি গ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসেন। গত দুই মাস ধরে হিন্দু শিবিরে বাস করছেন। তিনি জানান, বেলা ১১টার মধ্যেই ভাত রান্না শেষ হয়ে যায়। বড় বড় পাতিলে ভাত-তরকারি রান্না হয়। তরকারি হিসেবে থাকে যেকোনো একটি নিরামিষ।

কুতুপালংয়ের এই শিবিরে বেসরকারি সংস্থা কোস্টাল ও ব্র্যাকের দুটি মেডিকেল টিম কাজ করছে। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া ছাড়াও বিনা মূল্যে এখানে বিভিন্ন রোগের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। কোস্টালের মেডিকেল সহকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, তাদের কাছে ডায়রিয়া ও চর্মরোগ নিয়ে অনেকে আসে। প্রতিদিন অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন রোগীকে তারা চিকিৎসাসেবা দেয়। বড় ধরনের রোগ হলে উপজেলা হাসপাতাল কিংবা জেলা হাসপাতাল রোগীকে পাঠানো হয়।

আমরা যখন কুতুপালংয়ের হিন্দু শরণার্থীশিবির থেকে বেরিয়ে আসছিলাম তখন একদল শিশুকে পথের ধারে খেলা করতে দেখলাম। আমাকে দেখে নিজেদের ভাষায় কী যেন ওরা বলছিল। কিন্তু বুঝে উঠতে পারলাম না। মাথায় শুধু তখন একটা ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছিল।

দেশান্তরি হওয়া মানুষগুলো আজ কতটা অমানবিকভাবে দিন কাটাচ্ছে? মানুষ কতটা অসহায় হলে তাকে মুরগির খামারে থাকতে হয়! তারা এভাবে বেঁচে থাকতে চায় না। মিয়ানমারের অসহায় শরণার্থীরা এই কষ্টের জীবন থেকে কবে মুক্তি পাবে? তারা তো মানুষ!

এমটিনিউজ২৪/এম.জে/ এস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে