মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৪৩:১২

ভুয়া জামিননামায় ৬১ আইনজীবীর সই!

ভুয়া জামিননামায় ৬১ আইনজীবীর সই!

হকিকত জাহান হকি: ভুয়া জামিননামায় স্বাক্ষর করে কারাগার থেকে ১১০ আসামি ছাড়িয়ে নিয়েছেন ৬১ আইনজীবী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আদালতের জামিন-সংক্রান্ত নথি যাচাই করে ৭৭টি মামলার ৭৭টি ভুয়া জামিননামায় ৬১ আইনজীবীর স্বাক্ষর থাকার প্রমাণ পেয়েছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপ-সহকারী পরিচালক শফি উল্লাহ। সূত্র জানায়, মাদক চোরাচালানের অভিযোগে দায়ের করা ৭৭টি মামলার ১১০ আসামিকে ভুয়া জামিননামায় বের করে আনা হয় গত এক বছরে। পেশকার মোসলেউদ্দিন ও পিয়ন শেখ নাঈম ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত দ্বিতীয় দায়রা জজ শামসুন্নাহারের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া জামিননামা তৈরি করে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে রিলিজ লেটার হস্তান্তর করে ১১০ আসামি ছাড়িয়ে আনেন। দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, আইনজীবীরা যদি জামিননামাটি ভুয়া জেনে স্বাক্ষর করে থাকেন সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী আইনের আওতায় আসবেন। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের অভিযুক্ত করা হবে। জামিননামায় স্বাক্ষর করা আইনজীবী বলেন, আদালতে ওইসব মামলার শুনানির পর আদালত থেকে জামিননামা চাওয়ার পরই আইনজীবীদের পক্ষ থেকে জামিননামা পেশ করা হয়েছে। আইনজীবীরা তাদের নাম, ঠিকানা, সিল, স্বাক্ষরসহ সেসব জামিননামা পেশ করেছেন। কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে সঠিক নাম, ঠিকানাসহ জামিননামা পেশ করা হতো না। তারা বলেন, জামিননামা আদালতে পেশ করার পর এ নিয়ে আইনজীবীদের আর কোনো কাজ থাকে না। বাকি কাজ আদালত থেকে করা হয়। বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে জাল জামিননামা তৈরির বিষয়টি সম্পর্কে আইনজীবীরা অবহিত নন। জামিন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত দ্বিতীয় দায়রা জজ শামসুন্নাহারের আদালতে। প্রতিটি জামিননামায় এ বিচারকের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এক বছর আগে বিষয়টি জানাজানির পর এ নিয়ে তোলপাড় হলেও আসামি ও আইনজীবীর নাম জানা যায়নি। দীর্ঘদিন পর গত ৯ অক্টোবর ভুয়া জামিননামায় ছাড়া পাওয়া ১১০ আসামির নাম ছাপা হয়েছে। এবার ভুয়া জামিননামায় স্বাক্ষর থাকা ৬১ আইনজীবীর নাম জানা গেছে। এ অভিযোগ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদে আইনজীবীরা ওইসব জামিননামায় তারা স্বাক্ষর দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। তদন্তের লক্ষ্যে বিচারক শামসুন্নাহারের আদালত থেকে ৭৭ মামলার জামিননামাসহ নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব জামিননামা ও নথিতে রয়েছে ৬১ আইনজীবীর স্বাক্ষর। মামলার নথিতে ও জামিননামায় দেওয়া আইনজীবীদের স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখা হয়েছে। বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া জামিননামায় কারাগার থেকে আসামি মুক্ত করার অভিযোগে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির উবায়দুল করিম আকন্দ বাদী হয়ে পেশকার মোসলেউদ্দিন ও পিয়ন শেখ নাঈমকে আসামি করে গত ১১ জুলাই কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩-এর উমেদার ইসমাইলকেও সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনজনই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া জামিননামা তৈরির কথা স্বীকার করেছেন। জানা গেছে, চলতি বছরের মাঝামাঝিতে জামিন জালিয়াতির ওই ঘটনা ধরা পড়ার পর ওই আদালতের বিচারক বলেছেন, জামিননামায় দেওয়া স্বাক্ষরটি তার নয়। জামিননামায় স্বাক্ষর থাকা আইনজীবী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, তার মামলাটি শুনানির পর বিচারক জামিনের আদেশ দিয়েছেন বলে আদালতের পিয়ন শেখ নাঈম একই চেম্বারের আইনজীবী নূরে আলমকে অবহিত করেন। এ ক্ষেত্রে জামিননামা (বেলবন্ড) দিতে বললে নূরে আলম তাকে (সিরাজুল ইসলাম) জানান। পরে তিনি স্বাক্ষর করে জামিননামাটি আদালতে জমা দেন। তিনি বলেন, এতে তার কোনো অপরাধ নেই। আইনজীবী জগন্নাথ সাহা বলেন, 'ওই আদালতের পেশকার, মোসলেউদ্দিন ও পিয়ন নাঈম জামিননামা চাওয়ার পর আমার স্বাক্ষরসহ তা আদালতে জমা দিয়েছি। এরপর আদালত থেকে রিলিজ লেটার কারাগারে পাঠিয়ে আসামি মুক্ত করা হয়েছে। এখানে আমার কোনো ত্রুটি নেই।' আইনজীবী কাজী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, 'মামলার শুনানির পর আদালত থেকে জামিননামা চাওয়ার পর চেম্বারের সিনিয়র আইনজীবী তোবারক উল্লা ভূঁইয়ার নির্দেশে আদালতে জামিননামা পেশ করেছিলাম। তার পরের বিষয়টি ছিল আদালতের। সেখানে আমাদের কিছু করার নেই।' আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, মামলার শুনানি শেষে আদালত থেকে জামিননামা চাওয়ার পরই তা পেশ করা হয়। ওই জামিননামায় নিজের নাম, স্বাক্ষর, সিল, ঠিকানাসহ সব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। জামিননামা নিয়ে আদালত কী করবেন, এটা আইনজীবীর জানার কথা নয়। তিনি বলেন, আদালত থেকে ভুয়া জামিনে আসামি ছাড়িয়ে আনা হবে_ এ তথ্য জানা গেলে কোনো আইনজীবী জামিননামা পেশ করতেন না। একটি সূত্র জানায়, প্রতিটি মামলার জামিনের ক্ষেত্রে আসামি পক্ষের লোকজনের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী ৭৭ মামলায় জামিন দিয়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে। ভুয়া জামিনে ছাড়া পাওয়া আসামিদের সবাই মাদক চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ৬১ আইনজীবীর নাম :ভুয়া জামিননামায় স্বাক্ষর থাকা আইনজীবীরা হলেন_ দেলোয়ার হোসেন তালুকদার, আবদুল কাদের জিলানী, জগন্নাথ সাহা, সাইফুল ইসলাম সোহেল, এইচ এম নুরুল আলম, এস এম এ বারেক বাদল, জাহাঙ্গীর হোসেন, বিশ্বজিৎ সাহা, রফিকুল ইসলাম, গোলাম নবী, মোস্তাক আলী সিদ্দিকী, মফিজ উদ্দিন আহমেদ, তারেজুল ইসলাম, এস এম সিহাব, নুরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, এ এস কে সাইফুর রহমান, আ. সাত্তার মিঠু, জাফর খান, আলমাছ আলী, এনামুল বাহার, ফজলুর রহমান, মশিউর রহমান টিটু, এম এ মালেক, সাইফুল ইসলাম, এটিএম এনামুল হক তাহের, ইসমাইল হোসেন, ফয়সাল জিয়াউল হক, হাফিজুর রহমান তোতা, জিয়াউর রহমান, বাবুলুর রহমান, কামরুল ইসলাম, আবু সাঈদ মিয়া, হেলেনা আক্তার, সিরাজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম খান, মতিন মিয়া, নূর মোর্শেদ, এস এম মোস্তাক আহম্মেদ, জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, জি এ এম শাহজাহান, মোহাম্মদ শফিকুল আলম, সৈয়দ জিল্লুর রহমান, জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, আমিরুল হায়াত খাঁ, হুমায়ুন কবির, মোহাম্মদ মনির হোসেন, মোশারফ হোসেন মোল্লা, মোফাজ্জল হোসেন ফারুক, মোহাম্মদ ইশারত হোসেন, হাজেরা বেগম (আজরা), এস এম জাবিরুল হক, শিহাব উদ্দিন আহম্মেদ টিপু, ইসমাইল হোসেন, রায়হানা নাজনীন জুঁই, প্রবীর রঞ্জন দাস, শাহ আলী ভূঁইয়া মিলন, আলহাজ আল আমিন, ড. জাফর হাসান রুবেল, ইউনুস আলী ও কাজী রিয়াজুল ইসলাম।-সমকাল ১০ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে