সুদের হার কমলেও ঋণের চাহিদা কম
নিউজ ডেস্ক: ব্যাংকঋণের সুদের হার কমছে। নতুন প্রকল্প গড়তে আগে ১৫ শতাংশের কম সুদে ঋণ পাওয়া যেত না, এখন ৯ শতাংশ সুদেও ভালো গ্রহীতাদের ঋণ দিতে রাজি ব্যাংকগুলো। এর পরও ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে ব্যাংকে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে সার্বিকভাবে ঋণ বিতরণের গতি কমে গেছে।
আবার যারা ঋণ নিতে আগ্রহী তাদের অনেকের জন্য ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। নতুন, ছোট ও মাঝারি এবং অতীত রেকর্ড ভালো নয় এমন বড় প্রতিষ্ঠান- সবার ক্ষেত্রেই ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো অনেক বেশি সতর্ক। পোক্ত জামানত চাওয়া হচ্ছে, যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে কঠোরভাবে। ফলে আগের মতো চাইলেই ঋণ পাচ্ছে না।
এসব কিছুর প্রভাব পড়ছে ঋণপ্রবাহে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১.০৭ শতাংশ।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক ও বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, 'এখন ১০ শতাংশের কম সুদেও ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু নতুন প্রকল্প প্রস্তাব নেই। যতটুকু ঋণ বিতরণ হওয়ার কথা তার চেয়ে কম হচ্ছে। এটা আমাদের চিন্তিত করছে।'
ব্যবসায়ীরা এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, বড় কারণ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ায় অনিশ্চয়তা ও বিড়ম্বনা। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিভিন্ন খাতে মন্দাভাব, রপ্তানি খাতে গতি কমে যাওয়া প্রভৃতি কারণও উল্লেখ করছেন তাঁরা। অনেকের মতে, বেসরকারি খাতে কম সুদের বৈদেশিক ঋণও ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ তৈরি করেছে। অনেক বড় শিল্পগোষ্ঠী বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে। দেশীয় ব্যাংকের টাকা তাদের লাগছে না। ঋণের জন্য সবচেয়ে খরুচে বছর ছিল ২০১২ ও ২০১৩ সাল। তখন গড় সুদের হার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ১৮-২০ শতাংশ সুদেও ঋণ দিয়েছে। এখন সেদিন নেই। এখন সাধারণ ব্যবসায়ীরাও ১৩-১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারেন। আর বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ১০ শতাংশের কাছাকাছি সুদে ঋণ দিতে ব্যাংক কর্মকর্তারা ঘুরছেন। ফলে গড় সুদহার এখন ১১.৪৮ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু ঋণপ্রবাহে জোয়ার আসছে না। বরং ঋণ বাড়ার গতি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত জুন থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ার গতি কমছে। জুনে ওই খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি ছিল ১৩.১৯ শতাংশ। আর জুলাইয়ে ছিল ১২.৯৬ শতাংশ। আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ১২.৬৯ শতাংশ হয়েছে। ওই মাস শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৭৮ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪.৩ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ঋণ বিতরণ না বাড়লে মোট ঋণের প্রবৃদ্ধি ওই প্রাক্কলনের চেয়ে কম হতে পারে।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদ উদ্দিন মনে করেন, ঋণের সুদের হার কমলেও গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে অনেক ব্যবসায়ী নতুন শিল্পের জন্য ঋণ নিতে আগ্রহী নন। তিনি বলেন, 'বর্তমানে ঋণের চাহিদাই কম। সামান্য চাহিদা আছে চলমান শিল্প কারখানার সংস্কার বা সম্প্রসারণের জন্য। নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য ঋণের চাহিদা নেই।' ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি হোসেন খালেদ বলেন, সুদের হার কমে যাওয়ায় এখন বিনিয়োগের সুবর্ণ সময়। তবে প্রয়োজন গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা। বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু শিল্পে বিদ্যুৎ পাওয়া আরো কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। নিজের দুটি কারখানায় দেড় বছর ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে হোসেন খালেদ বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলে এখনই সেখানে সাড়ে তিন হাজার কারখানা চালু করা সম্ভব। ঢাকা ও আশপাশে এ সংখ্যা সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার হবে। প্রসঙ্গত, কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের 'সহজে ব্যবসা সূচক-২০১৬' অনুযায়ী ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া সবচেয়ে কঠিন। এ দেশে একটি সংযোগ পেতে গড়ে ৪২৯ দিন অপেক্ষা করতে হয়।
হোসেন খালেদ বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণ পাওয়া এখন আরো কঠিন হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের শর্ত পূরণ করতে পারছে না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে একমত আবদুস সালাম মুর্শেদীও। তিনি জানান, মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে এখন অনেক সতর্ক।
উল্লেখ্য, মন্দ ঋণের পরিমাণ এখন ৫২ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, যা বিরতণ করা মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দ ঋণ কমাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
সার্বিকভাবে অর্থনীতি একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, বিনিয়োগের জন্য জমি পাওয়া কঠিন। আবার জমি পেলে গ্যাস পাওয়া যায় না, গ্যাস পেলে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কী করবেন? পুঁজিবাজার ও আবাসন খাত চাঙ্গা না থাকায় ব্যক্তি খাতে ঋণ কমেছে। আগে মানুষ ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনত। এখন সেটা কিনছে না।
১০ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি