মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:৫৩:৩৯

নেপিডোর গণতন্ত্রায়ণে ঢাকার নতুন সম্ভাবনা

নেপিডোর গণতন্ত্রায়ণে ঢাকার নতুন সম্ভাবনা

মেহেদী হাসান ও ওমর ফারুক: গণতন্ত্রায়ণ ও ক্ষমতার পালাবদলে উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে মিয়ানমার। প্রায় ২৫ বছর পর দেশটিতে আসছে গণতান্ত্রিক সরকার। ফলে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। একে কাজে লাগানোর পাশাপাশি পুরনো সমস্যাগুলোর সমাধান করাও ঢাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, অবৈধভাবে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ঘিরে তৈরি হওয়া এ সমস্যার রাতারাতি সমাধান আশা করা ঠিক হবে না। এ বিষয়ে মিয়ানমারে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকাই মূল কারণ। তবে গণতন্ত্রায়ণ যেহেতু শুরু হয়েছে, তাই বিশ্লেষকদের আশা, নতুন গণতান্ত্রিক সরকার সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেবে। আর এর মধ্য দিয়ে আগামী দিনে এ সমস্যার সমাধানে পৌঁছা যাবে। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতার পালাবদল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও একে আরো এগিয়ে নিতে চায় বাংলাদেশ। দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া আগামী দিনে আরো গতি পাবে বলে ঢাকা আশা করছে। প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত আছে বাংলাদেশের। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা ও স্থল সীমান্ত সমস্যার ঐতিহাসিক সমাধান হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আছে। পাশাপাশি সম্প্রতি নিরাপত্তা, সেনা সমাবেশ, যুদ্ধ পরিস্থিতি, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা ও মাদক ইস্যুতে সীমান্ত সংঘাত দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে। গত কয়েক বছরে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সময় সীমান্তে বিনা উসকানিতে আক্রান্ত হয়েছেন এ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য নিহতও হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যকে অপহরণও করেছে। মিয়ানমারের নির্বাচনে গণতন্ত্রায়ন ও রাজনৈতিক পালাবদলে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, 'মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠবে বলে আমরা আশা করি। আমরা চাই, দেশটিতে গণতান্ত্রিক সরকার সবাইকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক সমাজ গড়ে তুলবে। রোহিঙ্গা সমস্যার প্রধান কারণ দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো। খুব দ্রুত এর সমাধান হবে এমনটি আমি মনে করি না।' মিয়ানমারের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তাদের অগ্রযাত্রায় আমরাও শরিক হতে চাই। অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন খাতে সম্পর্ক জোরদার হলে দুই দেশই উপকৃত হবে।' ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২৫ বছর ধরে মিয়ানমারে সামরিক শাসককেন্দ্রিক যে সরকারগুলো এসেছে সেগুলোর সময় বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধ বেড়েছে। দেশটিতে ক্ষমতার পালাবদল ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া অবশ্যই ইতিবাচক। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের সুযোগ যেমন বাড়বে, তেমনি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের সম্ভাবনা 'অনেক' উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভৌগোলিকভাবে দেশটির অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার যদি সুসম্পর্ক গড়তে পারে, তাহলে বড় শক্তি যেমন ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায্য অনেক প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। নেপিডোর নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ঢাকার জোরালো প্রয়াস চালানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। সবাই এখন দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্ত লাগোয়া প্রতিবেশী। অতীতে সংকটময় সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটি ঢাকার সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছে। তাই বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও সুযোগ বেশি। তবে এটি কাজে লাগানোর জন্য সক্রিয় ও জোরালো কূটনীতি প্রয়োজন। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন থাকলেও অপরাধীদের মধ্যে সখ্য রয়েছে। বাংলাদেশে ইয়াবা সরবরাহের জন্য সরকারি বাহিনীর সহযোগিতায় কারখানা তৈরি করে তা পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের বড় একটা অংশ এসে নানা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বেশ জোর দেওয়া হলেও এত দিন দেশটির জান্তা সরকার সেগুলো খুব বেশি আমলে আনেনি। নতুন সরকার এ সমস্যা সমাধানে কতটা আগ্রহী হয় সেদিকে দৃষ্টি থাকবে বাংলাদেশের। তবে এ সমস্যার দ্রুত সমাধান নিয়ে শঙ্কাও আছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তার নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। গত রবিবার অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তারা ভোটও দিতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেই যেন রাজনৈতিক ঐক্য আছে ওই দেশের দলগুলোর মধ্যে। নির্বাচনের ফলাফলে এগিয়ে থাকা অং সান সু চির ২০১২ সালের এক বক্তব্য হতাশ করেছিল বাংলাদেশকে। সে বছরের নভেম্বর মাসে ভারত সফরের সময় তিনি বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাঁর ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছিল, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই। নিজেদের কলহ আর অভ্যন্তরীণ বিবাদে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সু চির ওই বক্তব্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে দেশটির সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও অনুসৃত নীতির পরিপন্থী। গত বছরের আগস্ট মাসে ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনায় মিয়ানমার পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে দুই হাজার ৪১৫ জন নাগরিককে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে সম্মত হয়। সেটিকে তখন ঢাকার পক্ষ থেকে 'বড় অর্জন' বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ফিরিয়ে নেওয়ার সে প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাধারণ নির্বাচনের পর দেশটি ওই প্রক্রিয়ার দিকে নজর দেবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিলেও এ বছরের বিভিন্ন সময় সাগরে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের দ্রুততম সময়ে ফিরিয়ে আনতে ঢাকাকে চাপ দিয়েছে দেশটি। গত ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ৭২৯ বাংলাদেশির সবাইকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশ বলেছে, মিয়ানমারও একইভাবে এ দেশে বছরের পর বছর ধরে প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষমাণ তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে ঢাকা আশা করছে। বাংলাদেশের দুটি শরণার্থী শিবিরে ২৯ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এর বাইরে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছে। ২০০৫ সাল থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে তার দেশের নাগরিকদের প্রত্যাবাসন বন্ধ রেখেছে। এ সমস্যাই দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে বড় বাধা। এটি সার্বিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের প্রয়াস চালানোর পাশাপাশি অন্য ইস্যুতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। আগামী দিনেও এটি অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, সম্পর্কের উষ্ণতা প্রকাশ পায় শীর্ষ পর্যায়ে সফর বিনিময়ের মাধ্যমে। এসব সফর ঘিরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের রূপরেখা পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের মার্চ মাসে বিমসটেক সম্মেলন উপলক্ষে মিয়ানমার সফর করেন। দ্বিপক্ষীয় সফরে দেশটির প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও কয়েক বছর ধরে তা ঝুলে আছে। নতুন সরকার গঠনের পর দ্রুততম সময়ে শীর্ষ পর্যায়ে সফর বিনিময়ের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।-কালের কণ্ঠ ১০ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে