মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৫১:২৬

জনশক্তি রফতানি খাতে অশনি সংকেত

জনশক্তি রফতানি খাতে অশনি সংকেত

রবিউল হক: বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতে সবচেয়ে অস্থির সময় চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব বন্ধ বাজারগুলো নতুনভাবে খোলার চেষ্টা হলেও সফল হয়নি। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘমেয়াদি সহিংস যুদ্ধে রূপ নেয়া, নিজস্ব জনশক্তিকে কাজে লাগানো, কূটনৈতিক ব্যর্থতা সেই অনিশ্চয়তাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এ ছাড়া নতুন শ্রমবাজার খোঁজার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সফলতার দেখা মেলেনি। এ অবস্থায় দেশের প্রায় ১২০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক বাদে বাকিগুলো কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য ও বৃহত্তম শ্রমবাজারগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এ খাতে অশনি সংকেত দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ছিল সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ। এসব প্রতিটি দেশে এক সময় বছরে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। বর্তমানে ১৬০টি দেশে জনশক্তি রফতানি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশসহ মাত্র ২০টি দেশে যে সংখ্যক কর্মী যায়, তার ২০ ভাগের এক ভাগও যাচ্ছে না বাকি ১৪০ দেশে। কিন্তু গত ৭ বছর ধরে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ, তিন বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার বন্ধ, সরকার পতনের আন্দোলন ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে ইরাক ও লিবিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ, কুয়েতের শ্রমবাজারও প্রায় ৮ বছর বন্ধ। রোমানিয়া, গ্রিস, ইতালিসহ ইউরোপের কিছু দেশেও বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে এসব দেশও এখন আর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না। বিএমইটি সূত্র জানায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৬০টি দেশে মোট ৪ লাখ ২৮ হাজার কর্মী পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ২০টি দেশেই গেছে ৪ লাখ ৮ হাজার কর্মী। আর বাকি ১৪০ দেশে গেছে মাত্র ১৮ হাজার কর্মী। ২০টি দেশের মধ্যে কাতার, ওমান ও সিঙ্গাপুরে গেছে দুই লাখ ৩৬ হাজার কর্মী। অথচ সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়ার মতো বড় শ্রমবাজারে বলার মতো জনশক্তি রফতানি হয়নি। এ অবস্থায় নতুন ও বড় শ্রমবাজার তৈরি না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই জনশক্তি রফতানি খাতে অন্ধকার নেমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী জানান, বাংলাদেশের শ্রমবাজার যে নেই তা নয়। কিন্তু সে বাজার থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন কারণে দূরে সরে যাচ্ছে। সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে এমনটি হচ্ছে। সরকার বিদেশি শ্রমবাজার ধরে রাখতে সত্যিকার অর্থে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে বড় বড় শ্রমবাজার ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। সৌদি আরবে ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ। এ বছরের জানুয়ারিতে সিদ্ধান্ত হয়, দেশটি ফের বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবে। কিন্তু দেশটি শর্ত দেয় আগে ৫০ হাজার গৃহকর্মী পাঠাতে হবে। কিন্তু সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে মাত্র কয়েক হাজার গৃহকর্মী পাঠানো সম্ভব হয়। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে পুরুষ কর্মী নেয়া থেকে বিরত রয়েছে দেশটি। সৌদি আরব বাংলাদেশি কর্মী নেয়া বন্ধ করার পর বিকল্প বাজার হয়ে ওঠে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ২০১২ সালে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও গত তিন বছরে খোলেনি আমিরাতের শ্রমবাজার। বর্তমানে কিছু গৃহকর্মী ছাড়া অন্য কোনো পেশায় ভিসা দিচ্ছে না আমিরাত সরকার। পরে ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ নির্বাচনে বাংলাদেশ দুবাইকে প্রথম দফায় ভোট না দেয়ায় বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়ে। বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি দেশটি। এ সময় দুবাইকে সমর্থন দিলে শ্রমবাজার খোলার বিষয়টি আরো সহজ হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ রাশিয়াকে সমর্থন দেয়। প্যারিসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি তিন দফা চলে এবং আমিরাত রাশিয়াকে পরাজিত করে ওয়ার্ল্ড এক্সপোর ভেন্যু হিসেবে নির্বাচিত হয়। গত বছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত সফরকালে শ্রমবাজারটি খুলবে বলে আশা করা হলেও তা হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্থানীয়দের চেয়ে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা নিরাপত্তা নিয়ে বেশ স্পর্শকাতর। এ অবস্থায় প্রায় প্রতিদিনই আমিরাতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বাংলাদেশিদের অপরাধসংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আমিরাতের জেলখানায় বাংলাদেশি কয়েদির সংখ্যা সর্বোচ্চ। এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি খুন, ডাকাতি, চোরাকারবারী, জুয়া, মাদক ব্যবসা করার অভিযোগে সে দেশের কারাগারে আছে। জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যেতে চায়। সেখানে গড়ে ৪ লাখের কিছু বেশি কর্মী বৈধ পথে পাঠানো সম্ভব হয়। অনেককে প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে নিয়ে যায় দালালরা। মালয়েশিয়ায় বছরে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী যাওয়ার সুযোগ আছে। ২০১৩ সালে জিটুজি পদ্ধতিতে নতুন করে কর্মী পাঠানোর চুক্তি হলেও তা ব্যর্থ হয়। এ পদ্ধতিতে গত দুই বছরে মাত্র ৮ হাজার কর্মী পাঠায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অথচ দেশটিতে ১৫ লাখ কর্মীর চাহিদা রয়েছে।-মানব কণ্ঠ ১০ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে