বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৪১:২৮

ধরপাকড়ে বিএনপি জোট ঘরছাড়া

ধরপাকড়ে বিএনপি জোট ঘরছাড়া

আশরাফ-উল-আলম ও শফিক সাফি: গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি-জামায়াত জোটের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর নতুন করে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় এই জোটের বহু নেতাকর্মী এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী বিশেষ অভিযান চালায়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সাত হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে এ সময় আটক করা হয় বলে জানা গেছে। গত শনিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল পর্যন্তই গ্রেপ্তার হয় পাঁচ হাজারেরও বেশি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরই শুধু নয়, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ওয়ার্ড এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, বিএনপি ও জোটকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই নতুন এই গ্রেপ্তার অভিযান। জোটের নেতাকর্মীরা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিশেষ কোনো কারণে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনার কথা অস্বীকার করে বলেন, এটা শুধুই রুটিন ওয়ার্ক। যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে মামলা রয়েছে বা আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, শুধু তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ২১০৩ ও ২০১৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা হরতাল-অবরোধ ডাকার পর সারা দেশে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ২০ দলীয় জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। কেন্দ্রীয়সহ তৃণমূলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়। ওই হরতাল-অবরোধ কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই গত বছর মার্চ মাসে বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে গ্রেপ্তারের হারও কমে যায়। প্রায় দেড় বছর ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। টানা কর্মসূচি চলাকালে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তারদের জামিনের ব্যাপারে দেশের আদালতগুলো কঠোর ছিলেন। নাশকতার মামলায় একবার গ্রেপ্তার হলেই তাকে মাসের পর মাস কারাভোগ করতে হতো। কিন্তু টানা কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার পর জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও জামিন নাকচ শিথিল হয়। অনেক নেতাকর্মী জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে। আবার অনেকে স্থানীয় থানা পুলিশকে হাত করে এলাকায় ফিরে আসে। নতুন করে গ্রেপ্তার অভিযান : হঠাৎ করে গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের লোকজনকে ধরপাকড় শুরু হয়। ওয়ারী থানা যুবদলের সভাপতি মো. ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে হরতাল-অবরোধসংক্রান্ত পাঁচটি মামলা ছিল। এ বছরের প্রথম দিকে তিনি জামিন পান। প্রতিটি মামলায় জামিন পেলেও তিনি বর্তমানে কারাগারে। গত মাসের মাঝামাঝি তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর মাণ্ডা ইউনিয়নের বিএনপি সমর্থক খুরশীদ আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তিনি কারাগারে আছেন। এভাবে সারা দেশে আটক অভিযান চলছে। গত শনিবার মধ্যরাত থেকে রবিবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১০৭ জন, খুলনায় ৬৫, রাজশাহীতে সাত, ময়মনসিংহে ১৬৩, জয়পুরহাটে ৯২, সাতক্ষীরায় ৫০, পিরোজপুরে ৪৫, ফেনীতে ৪২, মেহেরপুরে ১৪, বাগেরহাটে ১৯, ঝিনাইদহে ৯, গাইবান্ধায় ১৬ জন, শেরপুরে জামায়াত-শিবিরের দুই নেতা, নারায়ণগঞ্জে ৯ জন এবং রাজধানীসহ ঢাকা জেলায় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত সোমবার দিনাজপুরে ১২২ জন, যশোরে ৫৯, লক্ষ্মীপুরে ৫৫, বরিশালে ৪৯, গাইবান্ধায় ২১, ঝিনাইদহে ১৭, হবিগঞ্জে ১০, সিলেটে দুই, ঠাকুরগাঁওয়ে এক, নোয়াখালীতে ৯৬, কুড়িগ্রামে ছয়, নারায়ণগঞ্জে সাত এবং ঢাকা মহানগর ও জেলায় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যক্তিকে হরতাল-অবরোধসহ নাশকতার মামলা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এজাহারে নাম না থাকলেও অজ্ঞাতপরিচয় আসামির তালিকায় ঢুকিয়ে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। গত তিন সপ্তাহের মধ্যে গত তিন দিনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেশি। যত দিন যাচ্ছে গ্রেপ্তারের হারও তত বাড়ছে। এ কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা আতঙ্কে আছে। কেন গ্রেপ্তার অভিযান : গ্রেপ্তারের হার বাড়লেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই অভিযানকে শুধু রুটিন ওয়ার্ক বলেছেন। তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সম্প্রতি দুই বিদেশি নাগরিকের দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা, বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা জড়িত বলে তদন্তে তথ্য প্রমাণ মিলছে। এসব তথ্য বিশ্লেষণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করছে, ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করে সরকার তথা দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার পরিকল্পনা স্বার্থান্বেষীদের রয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যই ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করা হয়েছে। সরকারের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় কার্যকর বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে। তাঁদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতা হতে পারে- এই আশঙ্কায়ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ধরপাকড় শুরু করা হয়েছে বলে সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। আবার আগামী জানুয়ারিতে সরকারের বর্ষপূর্তিতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন বা কর্মসূচি দিলে তখনো সহিংসতা ঘটতে পারে- এই আশঙ্কায় আগে থেকেই নেতাকর্মী ও সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন : সন্ত্রাস ও নাশকতা দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রুটিন ওয়ার্ক বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সাম্প্রতিক ব্যাপক ধরপাকড় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপির একাধিক নেতা কালের কণ্ঠের কাছে অভিযোগ করেন, বিএনপিসহ সরকারের প্রতিপক্ষ জোটের নেতাকর্মীদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখার জন্য গণগ্রেপ্তার চালানো হচ্ছে। তাঁরা আরো জানান, নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকাছাড়া হয়েছে। অনেকের মতে, আগামী ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অংশগ্রহণের বিধান করায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ধরপাকড় চালাচ্ছে সরকার। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায়। এ প্রসঙ্গে যুবদলের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বৈধ হোক বা অবৈধ হোক, আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করছে। তবে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে তারা ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে। গ্রেপ্তারের নামে সরকার আতঙ্ক সৃষ্টি করে বিরোধী নেতাকর্মীদের এলাকাছাড়া করছে উল্লেখ করে আলাল বলেন, সামনের নির্বাচনে যাতে একটি পক্ষ অংশ নিতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, বিএনপির দুরবস্থা কেটে যাবে। ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম বলেন, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি মামলায় জর্জরিত। কিছু দিন বিরতি দিয়ে দিয়ে ধরপাকড় করার অর্থ হলো তারা যাতে আন্দোলনে নামতে না পারে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, এসব মামলা-হামলার উদ্দেশ্য বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করা। তবে এরশাদ সরকারও দমন-পীড়ন চালিয়ে টিকতে পারেনি। এ সরকারও পারবে না। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) মসিউর রহমান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার ধরপাকড় শুরু করেছে। উদ্দেশ্য, বিএনপির নেতাকর্মীদের নাজেহাল করা। তাঁরা বলেন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নাজেহাল করতে ঝুলে থাকা বিভিন্ন মামলায় অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। রাজধানীর সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, 'আমরা সবাই আতঙ্কিত, ধরপাকড়ের ভয়ে নেতাকর্মী সবাই এলাকাছাড়া।' তিনি আরো বলেন, 'যাতে বিএনপির নেতৃত্বে কেউ আন্দোলনে যেতে না পারে, সে জন্য এই ধরপাকড়।' জামিনে কঠোর আদালত : গত ১৬ অক্টোবর মাণ্ডা থানার বিএনপি সমর্থক খুরশীদ আলমকে গ্রেপ্তার করে মুগদা থানা পুলিশ। বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় তাঁকে। তাঁর পক্ষে আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করেন। আসামি খুরশীদ আলম মাণ্ডা ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক বলে পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলেও আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, ২০০১ সাল থেকে এই আসামি কঠিন ব্যাধিতে ভুগছেন। ভারতের নাইটিংগেল হাসপাতালে তিনি এ বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসাসংক্রান্ত কাগজপত্রও আদালতে দাখিল করা হয়। আসামির পুরো শরীরের মারাত্মক চর্মরোগ আদালতকে দেখানো হয়। আসামির শরীর ফেটে রক্ত বের হচ্ছে বলেও আদালতকে জানানো হয়। আইনজীবীরা বলেন, ১৫ বছর ধরে যিনি মারাত্মক রোগে ভুগছেন, তিনি রাজনীতি করেন কখন? তাঁর উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু আদালত তাঁকে জামিন দেননি। গত তিন সপ্তাহে হরতাল-অবরোধ ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক বিএনপি-জামায়াত জোট নেতাকর্মীদের কোনো জামিন দেননি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। একাধিক আইনজীবী এ তথ্য জানিয়েছেন। ঢাকার আদালতের ফৌজদারি মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী তরিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মী যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের জামিন দিচ্ছেন না আদালত। এ ব্যাপারে আদালতের কঠোর মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।-কালের কণ্ঠ ১১ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে