শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:৩৮:০৯

‘দুই নফসের যুদ্ধ এবং এক অতৃপ্ত আত্মার কথা!’

‘দুই নফসের যুদ্ধ এবং এক অতৃপ্ত আত্মার কথা!’

গোলাম মাওলা রনি : গত কয়েক রাত ধরে নিয়মিত ঘুম আসছে না। বেশ তোড়জোড় করে সন্ধ্যা রাতেই বিছানায় যাই বটে কিন্তু ঘুমাতে পারি না। আমার ভিতরকার দুটি নফস ইদানীং রাত হলেই একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেয়। নফসে আমমারা বলে, আমার সব কিছুই ঠিক আছে। দু-চারটা যা কিছু ভুলভ্রান্তি তা ওই নিমক-হারামদের জন্যই হচ্ছে। ওরা আমার নিমক গিলছে ঠিকই কিন্তু আমার গুণগান করছে না। কেউ কেউ সুযোগ পেয়ে সামনে এসে কোকিলকণ্ঠে আওয়াজ তোলে আমার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে চায় কিন্তু আড়ালে গিয়ে আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে। বাকি লোকজন আমার জন্য অন্তঃপ্রাণ।

বিশেষ করে যাদের প্রতি আমার কোনো দান কিংবা অনুগ্রহ নেই তারাই নাকি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। নফসে আমমারার কথা শুনে আমার চোখে ঘুম চলে আসে। সে আরও বলে- আমি নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে অভিজাত রক্তের ধারক। আমার জ্ঞান-বুদ্ধি সক্রেটিস, কনফুসিয়াস কিংবা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো। আমার সাহস-শক্তি আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার কিংবা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের চেয়ে কম নয়- বরং বেশি। আমি ভালো কাজ করতে করতে ওলি-আল্লাহ হয়ে গেছি। সারা দুনিয়ার লক্ষ কোটি মানুষ আমাকে তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে এবং আমার জন্য দোয়া না করে ঘুমাতে যায় না।

এত ভালো ভালো কথা শুনে যেই না চোখ বুজতে যাব ওমনি নফসে লাও ওয়ামা সামনে চলে আসে। বলে আমি নাকি মিথ্যাকে আমার অলঙ্কার বানিয়ে ফেলেছি। মোনাফেকি নাকি আমার মাথার তাজ হয়ে গেছে। অজ্ঞানতা, অহঙ্কার, জুলুম এবং অত্যাচার নাকি আমার প্রধান হাতিয়ার হয়ে গেছে। আমি নাকি আল্লাহর জমিনের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছি। নিজের কুকর্ম দ্বারা আমি নাকি ধীরে ধীরে নিজের হিদায়েতের দরজা-জানালাসমূহ বন্ধ করে দিচ্ছি এবং ক্রমাগত অন্যায়-অবিচারের মাধ্যমে তওবার রাস্তাটিকে পর্যন্ত সংকুচিত করে ফেলেছি। আল্লাহর নেয়ামত এবং বরকতের তুলনায় মানুষের অভিশাপ নাকি আমার পাথেয় হয়ে গেছে। আমার নিজের কুকর্ম, কুচিন্তা এবং কুৎসিত মন যেমন আমাকে কলঙ্কিত করছে তদ্রূপ আমার সাহায্যকারীদের সব কুকর্মের দায়ও নাকি আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে।

নফস সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা ছিল। মানুষ সবসময় প্রধানত দুটি নফসের দ্বারা পরিচালিত হয়। যার ভিতরে নফসে আমমারার প্রভাব বেশি থাকে তার জন্য আর ইবলিশের দরকার হয় না। এই নফসটি যদি খুবই শক্তিশালী হয়ে পড়ে তবে ইবলিশও সতীত্ব হারানোর ভয়ে নফসের ধারকের ধারের কাছে আসে না। মানুষের মধ্যে কার্যকর দ্বিতীয় নফসটির নাম নফসে লাও ওয়ামা। এটি হলো মানুষের ভালোমন্দ বাছ-বিচার করার ক্ষমতা। লাও ওয়ামা যদি আমমারার ওপর বিজয়ী হতে পারে তবে আখিলেহ নামক একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন মানুষ নিরপেক্ষভাবে ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করে চিন্তা করতে পারে। ঠিক তখনই আবেগ, ক্রোধ, কাম এবং হিংসা তার ওপর প্রলয়ঙ্করী প্রভাব বিস্তার করতে পারে না- সে বিজয়ী হওয়ার পথে এগোতে থাকে।

আখিলেহর পরবর্তী স্তরকে বলা হয় নফসে মুলহিমা। ওই অবস্থায় মানুষের হৃদয় তার রবের কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করে। তার মধ্যে নিত্যনতুন ভালো কাজ করার আগ্রহ জাগে। সে মন্দ কাজকে পরিহার করে ভালোর দিকে ছুটে চলাকে জীবনের পাথেয় মনে করতে করতে নফসে মুতমাইন্নার দরজায় পেঁৗছে যায়। এদের সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কোরআনের ৮৯ নম্বর সূরা ফাজ্বরের ২৭ থেকে ৩০ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত বলেছেন। এদের বলা হয় প্রশান্ত আত্মা। এরপরের মাকামের নাম রাজিয়াহ।

এ অবস্থায় বান্দা সবসময় নিজেকে আল্লাহর ওপর রাজি ও খুশি অবস্থায় দেখতে পায়। বান্দার নফসের জন্য এই দুনিয়ায় সর্বোচ্চ স্তরের মাকামের নাম- মারজিয়াহ। এই স্তরে প্রশান্ত আত্মার নফসের অধিকারীর ওপর স্বয়ং আল্লাহ রাজি-খুশি হয়ে যান। সাত প্রকার নফসের কার্যকারিতা সম্পর্কে টুকটাক জ্ঞান থাকার দরুন আমি পরম ধৈর্য নিয়ে নফসে লাও ওয়ামার সমালোচনাগুলো শুনতে থাকলাম। সে আরও বলল, আমিই নাকি আমার সমাজের সব কুকর্মের প্রধান হোতা। আমাকে নাকি লোকজন প্রচণ্ড ঘৃণা করে এবং আমার কথা-কর্ম ইত্যাদি এক চুল পরিমাণও বিশ্বাস করে না। আমার মন-মস্তিষ্ক সবসময় নাকি অপরের অনিষ্ট সাধনের জন্য প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে।

অন্যদিকে, কোনো শুভ কর্ম, শুভ চিন্তা কিংবা পরিকল্পনার বিষয় আমার সামনে এলে আমি নাকি একেবারে নির্বোধ হয়ে পড়ি। দুনিয়ার মন্দ মানুষের সঙ্গে আমার দহরম এবং মহরমের পাশাপাশি আমি চারদিকে বেকুব, ভাঁড়, অর্থব এবং অপদার্থদের দিয়ে এমন এক পাষাণ দেয়াল তৈরি করেছি, যা ভেদ করে আর্তমানবতার চিৎকার, মজলুমের হাহাকার কিংবা সাধুজনের সদুপদেশ আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। শুধু কি তাই! প্রাণীকুলের কষ্ট, কান্নাকাটি, হাহাকার, অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-যাতনা দেখে নাকি আমার চিত্ত প্রফুল্লতা অনুভব করে।

লাও ওয়ামার কথা শুনতে শুনতে আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ইচ্ছে হচ্ছিল জোরে একটা চিৎকার দিই এবং কিছু জিনিসপত্র ভেঙে ফেলি। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি রাত দুটো বেজে গেছে। এত রাতে চিৎকার করলে আমার নিমক গ্রহণকারীরা সব ছুটে আসবে এবং সব কিছু দেখার পর সকালবেলা সবাইকে সে কথা বলে দেবে রং-চং মাখিয়ে। ওদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নিমক-হারামের দল সেইসব কাহিনীতে আরও রং মাখবে এবং চড়ামূল্যে আমার প্রতিপক্ষের কাছে পাচার করবে। আমি বিছানা ছেড়ে চুপিসারে রান্নাঘরে গেলাম। বিশাল বাড়ির দোতলায় আমি একাই থাকি।

নিচে থাকে পাইক-পেয়াদা, আয়া-বুয়া, মালি-ড্রাইভারসহ অন্যরা। রাতে জরুরি কিছুর দরকার হলে আমি কলিংবেল টিপি আর অমনি ১০-১২ জন ছুটে আসে আমার সেবার জন্য। আজ আমার মনটা ভারি অশান্ত হয়ে পড়েছে। কোনো মনুষ্য সানি্নধ্য আমার একদম ভালো লাগছে না, তাই চুপিচুপি লাইট না জ্বালিয়ে রান্নাঘরে গেলাম যেন নিচের লোকজন আমার নির্ঘুম রজনীর দুরবস্থা সম্পর্কে সামান্য আঁচ করতে না পারে। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে একটু ঠাণ্ডা পানি খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু ওখানে প্রবেশ করার পর আমার নাকে অদ্ভুত এক বিশ্রী দুর্গন্ধ এলো। মনে হলো অন্ধকারের মধ্যে কে যেন ওখানে হাঁটছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ গন্ধটি ছিল মরা মানুষের লাশের।

কিছুদিন আগে আমি সাবেক মার্কিন ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটনের লেখা আত্দজীবনীর বইটি পড়লাম। হিলারির মতো আধুনিক, শিক্ষিতা এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তার বইতে উল্লেখ করেছেন যে, হোয়াইট হাউসের বেশ কয়েকটি কামরা বিশেষ করে আব্রাহাম লিংকন বেডরুম বলে পরিচিত কামরায় ভূত রয়েছে। গভীর রাতে অশরীরী ভূতেরা সেখানে বিচরণ করে এবং লোকজনকে ভয় দেখায়। এ ঘটনা জানার পর ইদানীং আমাকে ভূতের ভয় পেয়ে বসেছে। রাত হলেই আমার অনেকের কথা মনে হয়, কিছুটা অস্পষ্ট হলেও আমি কিছু লোকের অন্তিম আহাজারির শব্দ শুনতে পাই। দিনকে দিন সেই সব শব্দের স্পষ্টতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মাঝে মধ্যে আমার ভীষণ ভয় হয় আর তখন প্রচণ্ড তৃষ্ণা পায়- ঠাণ্ডা পানির তৃষ্ণা। মনে হয় আস্ত একটি ঠাণ্ডা পানির সাগর আমি গিলে খেতে পারব।

রান্নাঘর থেকে রীতিমতো দৌড়ে আমি পুনরায় শোয়ার ঘরে ফিরলাম। সংযুক্ত বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে পানি দিলাম। আয়নায় নিজের ছবি দেখে আঁতকে উঠলাম। একি হাল হয়েছে আমার। মুখমণ্ডলের দুগালে বেশ বড়সড় দুটো কালো দাগ পড়েছে। থুঁতনির নিচের চামড়া মোটামুটি ঠিক থাকলেও কপালের চামড়া এবড়ো-থেবড়ো হয়ে পড়েছে। একটি চোখ অস্বাভাবিক রকম ছোট হয়ে গেছে। কুলকুচি করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার দাঁতগুলো বেশ ফাঁক হয়ে গেছে। দাঁতের গোড়ার মাংসগুলো সরে গেছে এবং ভিতরের অংশে কালো কালো দাগে ছেয়ে গেছে। আমি আনমনা হয়ে পড়লাম। ঠিক এমন সময় আমার শক্তিশালী নফস অর্থাৎ নফসে আমমারা নানা ছলে আমাকে উৎফুল্ল করে তুলল। আমি জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবার জন্য বিছানার ওপর শরীরখানি নেতিয়ে দিলাম।

আমার মন বলতে আরম্ভ করল, উঁচু অবস্থানে থেকে কেউ কোনো দিন নীতি নৈতিকতা দিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। আমার মন থেকে ধর্মবোধ মুছে ফেলতে হবে। ধর্ম দিয়ে জীবন চলে না। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রায় সব রাজা-মহারাজা, সেনাপতি, কোতোয়াল, জমিদার, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী বড় হওয়ার জন্য হয় ধর্মকে ব্যবহার করেছেন, নতুবা ধর্মকে পরিহার করেছেন। কেউ কেউ নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলেন আবার কেউ নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছিলেন। তারা কেউ ধর্ম পালন করেননি। বরং ধর্ম এবং ধর্মের নীতি নৈতিকতা অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক নামকরা মেধাবী ও উত্তম মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। কাজেই ওসব বাদ। আমাকে মনেপ্রাণে সেক্যুলার হতে হবে এবং সময় ও সুযোগ মতো ধর্মাবলম্বী লোকজনের সঙ্গে ছলচাতুরী করতে হবে। অর্থাৎ জনসম্মুখে স্থানকালপাত্র ভেদে আচরণ করতে হবে। এভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আমি বেশ উৎফুল্লবোধ করতে লাগলাম এবং ভুলে যেতে থাকলাম কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া আমার অন্তরলোকের নফসে লাও ওয়ামার আঘাতসমূহ।

আমি বীরের বেশে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। লাইট জ্বালালাম এবং রান্নাঘরে গিয়ে প্রথমে একপেট ঠাণ্ডা পানি এবং দু-তিনটা রসগোল্লা গলাধঃকরণ করলাম। দু-তিনটা বললাম এ কারণে যে, এত তাড়াহুড়ো করে রসগোল্লাগুলো খেয়েছিলাম এবং পরে কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না আমি আসলে কয়টি খেয়েছিলাম। শোবার ঘরে ফিরে আমি টিভি অন করলাম। চ্যানেল ঘুরিয়ে স্টার মুভিজে গিয়ে দেখি, মামি সিরিজে সিনেমা দেখাচ্ছে। এটি আমার প্রিয় একটি সিনেমা। আগের পর্বগুলোতে মিসরের ফেরাউনদের সমাধিক্ষেত্রে রক্ষিত মমিকে কেন্দ্র করে নানা ভৌতিক কাহিনী দেখাত। এই সিরিজের সর্বশেষ সিনেমাটির শুটিং হয়েছিল চীন দেশে। চীনের প্রথম সম্রাট শি হুয়ান টি মৃত্যুকালে তার সমাধিক্ষেত্রে প্রায় ১০ হাজার মাটির তৈরি সেনাবাহিনীকে সব রকম অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করে পাহারার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। ইতিহাসে এই বাহিনীকে টেরাকোটা আর্মি বলা হয়। ২৭ বছর রাজত্ব করার পর এই পাগলা সম্রাট মারা গিয়েছিলেন ২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১০ আগস্ট যখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫০ বছর।

কিন্তু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শি হুয়ান টি যার আদি নাম ছিল ইং ঝেং। তিনি একটি বৃহত্তর চীন রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে করেননি এমন কোনো অপকর্ম নেই। অন্যদিকে নিজের ক্ষমতা, প্রভুত্ব জাহির করা এবং নিজেকে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দেশের সব ক্ষমতাবান, জ্ঞানীগুণী এবং মেধাবীদের হত্যা করার পর চীন দেশের অতীতকালে রচিত সব বইপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাকে দিয়েই চীনের ইতিহাস শুরু হবে এবং বাস্তবে হয়েছেও তাই। কেবল এই পাগলা সোনামণির জন্যই চীন দেশের সবকিছু আমার ভালো লাগে এবং তার কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি আমার এত প্রিয়! সিনেমা দেখতে দেখতে আমি তন্ময় হয়ে ভাবতে লাগলাম- আহা! কি জৌলুস ছিল! মানুষকে অত্যাচার করতে করতে নির্মমভাবে মেরে ফেলার মধ্যেও যে বিনোদন থাকতে পারে তা এই সম্রাটকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।

সিনেমা দেখার ফাঁকে আমি কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম তা বুঝতেই পারতাম না যদি না সেই অতি আশ্চর্য স্বপ্নটি আমায় তাড়িত না করত।

তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আমি দেখলাম- বিশাল এক প্রান্তরে আমি কয়েক লাখ ভক্ত-অনুরাগীকে নিয়ে সিংহাসনে বসে আছি। আমি অনুমান করতে পারলাম না স্থানটি কোন দেশের কিংবা কোন সীমান্তের। তবে আমন্ত্রিত অতিথি এবং সৈন্য সামন্তের পোশাক-আশাক এবং অস্ত্রশস্ত্র দেখে ফের বুঝতে পারছিলাম যে মধ্যযুগের কোনো এক সময়ের অতিথি হয়ে আমি সেই প্রান্তরের রাজাধিরাজ রূপে কুরসিতে বসেছিলাম। আমার সিংহাসনের ডানদিকে আমার প্রচারকর্মে নিযুক্ত উজির দণ্ডায়মান ছিল এবং বামদিকে ছিল খাদ্য ভাণ্ডারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নাজির। আমি দেখলাম বহু সহস্র সৈন্য-সামন্ত নিয়ে কয়েকটি দল আমাকে কুচকাওয়াজের মাধ্যমে গার্ড অব অর্নার প্রদর্শনের জন্য সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে আমাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য এলেন সম্রাট শি হুয়ান টি এবং তার দল।

তারপর এলেন চেঙ্গিস খান, হালাকু খান এবং সবশেষে তৈমুর লং। অনুষ্ঠানস্থলে সম্মিলিত কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে মনে হলো আমিই পৃথিবীর বাদশাহ। মনের আনন্দে আমার গমভাজা খাওয়ার ইচ্ছে জাগল। আমি বামদিকে হাত বাড়ালাম। আমার হাতে কিছু ভাজা গম রাখা হলো। এরপরই আমার তন্দ্রা চলে গেল। চোখ খুলে তাকাতেই দেখি পুরো রুম অন্ধকার। আমি স্মরণ করার চেষ্টা করলাম তন্দ্রা যাওয়ার আগের মুহূর্তগুলো। রুমে তো লাইট জ্বালানো ছিল, টিভিও চলছিল। হঠাৎ করে সব আলো কোথায় মিলিয়ে গেল- এমন সব চিন্তা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ঠিক তখনই আমার কানে এলো গুনগুন কান্নার শব্দ। আমার বেডরুমের দরজার সামনে অন্ধকারের মধ্যে জড়সড় হয়ে কে যেন কাঁদছিল।

এবার আমি ভয় পেলাম না- বরং অতিরিক্ত সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম- কে? কে ওখানে? কান্নারত ছায়াটি বলল- আমি তোমার পিতা! মুহূর্তের মধ্যে আমার শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে গেল। আমি প্রবল বেগে দৌড় দিলাম পিতাকে স্পর্শ করার জন্য। পিতা কান্না থামিয়ে বললেন, স্থির হও বৎস! তুমি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না- এমনকি চিনতেও পারবে না। তোমার কর্ম পরলোকে আমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে। যদি পার তবে আমার কবরের কাছে যেও।

আমি বললাম, ওখানে তো আমি নিয়মিত যাই। পিতা বললেন, ওভাবে নয়- একাকী যাবে। গভীর রজনীতে পৃথিবীর সব কৃত্রিম আলো নিভিয়ে আল্লাহর দেওয়া চাঁদ-তারার আলোকে অবগাহন করতে করতে অজু-গোসল করে আমার কবরে যেও। আমি বললাম, কেন? পিতা উত্তর করলেন- বৎস! বহু বছর ধরে তুমি কেবল তোমার শত্রুদের মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে করতে একবারও ভাবার অবকাশ পাওনি যে তুমিও মরণশীল!-বিডিপ্রতিদিন

লেখক : কলামিস্ট
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে