বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৫৯:৩২

আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর

আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর

নিউজ ডেস্ক: আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর । ভোলাসহ উপকূলবাসীর কাছে আঁতকে উঠার দিন। ১৯৭০ সালের এই দিনে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল। সেই স্মৃতি বয়ে আজো যারা বেঁচে রয়েছেন কিংবা স্বজনদের হারিয়েছেন, কেবল তারাই অনুভব করেন সেদিনের ভয়াবহতা। ধারণা করা হয়, সেই দুর্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে ভোলা জেলাতেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিরান হয় অসংখ্য জনপদ। সেদিন উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরিত হয় লাশের নদীতে। ১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর বুধবার থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আবহাওয়া আরো খারাপ হতে থাকে এবং মধ্যরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে থাকে সমুদ্র। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসল পাহাড় সমান উচু ঢেউ। ৩০/৪০ ফুট উচু সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে মানুষের উপর। আর মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ, গবাদিপশু, বাড়িঘর এবং খেতের সোনালি ফসল। পথে-প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে পড়েছিলো কেবল লাশ আর লাশ। কত কুকুর, শিয়াল আর শকুন খেয়েছে সে লাশ তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সত্তরের সেই কালো রাতের কথা মনে হলে ধূসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসে হয়ে আসে বলে স্মৃতি রোমন্থন করেন ভোলার দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে। জন-মানুষ শূন্য হয়ে পড়েছিল দ্বীপ ভোলা।’ সেই সময়কার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলার সমস্ত জনপদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল আর নদীতে গবাদি পশুসহ বনি আদম সন্তান সারিবদ্ধভাবে পড়েছিল। তৎকালীন ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার ভোলা প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন ছিল ‘বাংলার মানুষ কাঁদো ॥ ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ’। আর এ সংবাদ বিশ্ব জানতে পেরেছিল চারদিন পর। সেই চিত্রটি আজো ঢাকা প্রেস ইনস্টিটিউট-এ কালের সাক্ষী হিসেবে বাঁধানো রয়েছে। সত্তুরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ধ্বংসযজ্ঞ ও বেদনাহতদের দেখতে যান, এসব দৃশ্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বলা হয়, এটাই ছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস। সেদিন ভোলা ছাড়াও উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আব্দুল্লাহ, সন্দীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামে ছিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষর। প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এম সানাউল্লাহ্ নূরী তখন দৈনিক বাংলায় (প্রাক্তন দৈনিক পাকিস্তান ) সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি লেখেন, (সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর) ‘আমরা রামগতি বাজারের নিকটবর্তী চর এলাকায় পৌঁছালাম। সেখানে স্তুপীকৃত লাশ এবং মৃত গবাদি পশুর যে হাল দেখলাম তা ভাষায় অবর্ণনীয়। রামগতি বাজারের একজন শৌখিন ফটোগ্রাফার আমাকে ফুলের মতো ফুটফুটে চারটি শিশুর ছবি দিয়েছিলেন। সেটি আমি ছেপেছি দৈনিক বাংলায়।’ তিনি আরো লেখেন, ‘আমি আমার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে থেকে একটানা কয়েকদিন ঢাকায় দৈনিক বাংলার জন্য রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলাম। এতে কাগজের প্রচার সংখ্যা ত্রিশ হাজার থেকে একলাখে উঠেছিল। চট্টগ্রামে সে সময় এক টাকা দামের কাগজ পাঁচ-ছ টাকা বিক্রি হচ্ছিল। আমরা চর বাদাম, চর সীতা এবং চর জব্বরে ধান খেতগুলোতে নাকে মুখে লোনা পানি লেপ্টানো হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। সাগরে ভাসতে দেখেছি অসংখ্য লাশ। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিলো ধ্বংসস্তুপে। একটি গাছের ৩০ ফুট উঁচু মাথায় অসহায় দুর্গত কুকুরকে দেখেছি হাহাকার করতে। কোথাও পানি উঠেছে ৪০ ফুট ওপরে। গোটা উপকূল অঞ্চলে প্রায় অর্ধকোটি লোক মৃত্যুবরণ করেছে। ১২৮৩ সনের গোর্কির চেয়ে বহুগুণে করুণ এবং ভয়াবহ ছিল ’৭০ সালের গোর্কি। এর ধ্বংসলীলা তো আমরা নিজের চোখেই দেখেছি। সারা দুনিয়ায় সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ হয়েছিল এই প্রলয় ভয়াল দুযোর্গের খবর।’ গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও এনজিও ‘ডরপ’ এর প্রতিষ্ঠাতা উপকূলের বাসিন্দা এ এইচ এম নোমান বলেন, ‘সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক কার্যক্রমকে দীর্ঘ ২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্যোগ, দুর্বিপাকে আত্মত্যাগে বলিয়ান ১২ নভেম্বর বার-বার আর ধ্বংসের বার্তা নিয়ে আসবে না বরং সৃষ্টির উম্মাদনা নিয়ে আসবে। আর সেই উম্মাদনার শক্তিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ প্রতিবার-প্রতি বছর। এদিনে প্রয়োজন সরকার-অসরকার ধন-মনের বৈষম্য কমিয়ে গরীবের অংশীদারী বিনির্মাণ করে সাম্যতা ও ন্যায্যতা সৃষ্টি করা। তাহলেই ৭০এর বন্যায় মৃতরা ও একাত্তরের জান দেওয়া বীরেরা আত্মার শান্তি পাবে।’ ১২ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে