শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:৪৭:০০

ট্রাক-ট্রলারে গরু আর গরু

ট্রাক-ট্রলারে গরু আর গরু

সাঈদুর রহমান রিমন : আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর ঘাটতি মেটাতে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান থেকে ১০ লাখেরও বেশি গরু আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসতে শুরু হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার সীমান্ত পয়েন্ট হয়ে গরু আসা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। তাই, কোরবানির চাহিদা অনুযায়ী দেশের হাটগুলোয় পর্যাপ্ত গরু থাকবে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সীমান্ত পয়েন্টে দেখা গেছে, ঢাকাগামী ট্রাকে গরু আর গরু। গরু আনা হচ্ছে ট্রলারে করেও।

বৈধ ও অবৈধভাবে পর্যাপ্ত গরু দেশে ঢুকে পড়ায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন দেশি খামারিরা। রাজধানী ও সংলগ্ন কোরবানির পশুর হাটগুলোয় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দেশীয় গরুর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক ভারতীয় গরু রয়েছে। ভারতীয় গরুর আধিক্য চলতে থাকলে বাজারে গরুর দাম অনেক কমে যাবে- এ রকম আশঙ্কা করছেন খামার ব্যবসায়ীরা। কিছু দিন বন্ধ থাকার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) হঠাৎ ‘নমনীয়’ হওয়ায় সে দেশ থেকে গরু আমদানি ব্যাপক বেড়েছে।

ঈদ যত এগিয়ে আসছে, আমদানিকৃত গরুর সংখ্যা ততই বাড়ছে। গরুর পাশাপাশি আসছে মহিষের চালানও। গরু ব্যবসায়ী ও সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ-ছয় দিনে শুধু দিনাজপুরের বিরামপুর, ফুলবাড়ী, বিরল ও বোচাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়েই অন্তত ১০ হাজার ভারতীয় গরু দেশে ঢুকেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পুটখালী ও সাতমাইল পশুর হাটে ফিরছে কোলাহল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের চারটি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন ১ হাজারেরও বেশি গরু আসছে।

ঈদ সামনে রেখে যশোরের শার্শা ও বেনাপোল সীমান্তের চোরাগলি দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার গরু-মহিষ আসছে। সাতমাইল ও ঝিকরগাছার পশুর হাটগুলো ভারতীয় গরুতে ভরে গেছে। জয়পুরহাটের তিনটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েও প্রতিদিন শত শত গরু ঢুকছে।

নাভারণ ভ্যাট অফিসের দায়িত্বে থাকা যশোর কাস্টমস ও ভ্যাট অফিসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হাফিজ উদ্দিন জানান, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পশু এসেছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৬০০টি আর চলতি বছর ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসেছে ৬ হাজার ৬৬টি। তবে ১২ সেপ্টেম্বর থেকেই সীমান্তের চেহারা হঠাৎ করেই বদলে গেছে। শার্শা উপজেলার প্রতিটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েই হাজার হাজার গরু নিয়ে ঢুকে পড়েছেন বেপারিরা। রাতারাতি হাটবাজার সব ভারতীয় গরুতে ভরে উঠেছে। গত তিন দিনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত পথে প্রায় ৭০ হাজার গরু ঢুকেছে। প্রতি রাতে বশিরহাটসংলগ্ন ইছামতী, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও মুর্শিদাবাদ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পানিপথে হাজার হাজার গরু ভাসিয়ে আনা হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের সীমান্তের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গেল বছরের চেয়ে এবার ৭-৮ গুণ বেশি পশু আমদানি হচ্ছে। জলসীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারিরা অনায়াসে গরু আনছেন। সীমান্তলাগোয়া নারায়ণপুর, পাখিউড়া, দইখাওয়া, চৌদ্দকুড়ি ও যাত্রাপুর এখন ভারতীয় গরুতে সয়লাব হয়ে পড়েছে। কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট সার্কেল কুড়িগ্রামের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছর জুলাইয়ে ১৮ হাজার ২০০, আগস্টে ২৫ হাজার ৮০০ ও সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ পর্যন্ত ১০ হাজার ৫০০ গরুর ট্যাক্স টোকেন দেওয়া হয়। গরু পাচার রোধে বিএসএফের কড়াকড়ি শুরুর পর থেকেই এ-দেশীয় গরু ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার থেকে গরু আমদানিতে ঝুঁকে পড়েন।

কোরবানির পশুর হাট সামনে রেখে মিয়ানমারের গরু আমদানি অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু আসছে মিয়ানমার থেকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে, ততই বাড়বে মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি। আর শুল্ক বিভাগ বলছে, এসব পশু আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে রাজস্ব। ভারত থেকে গরু আসা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছেন মিয়ানমারের দিকে। মিয়ানমার থেকে গরু আনার পর ব্যবসায়ীরা শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ ও সাবরাংসহ বিভিন্ন এলাকায় মজুদ করেন। এখান থেকে বিভিন্ন জেলায় এগুলো সরবরাহ করা হয়।

করিডর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম জানান, তারা মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম ১২ দিনে ১ হাজার ৯১২টি গবাদি প্রাণী আমদানি হলেও পরবর্তীতে তা আর গণনায় সীমাবদ্ধ থাকছে না। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই গরু আনছে দেশে। টেকনাফ থেকেই গরুর চালান যাচ্ছে চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়।

জানা যায়, ভারতীয় খামারিদের বিরাট একটি অংশ তাদের উৎপাদিত গরু ঈদের সময়টায় বাংলাদেশে বিক্রি করার ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক মাস সীমান্ত পয়েন্টগুলোয় গরু পাচার রোধে বিএসএফের কড়া নজরদারি থাকলেও হঠাৎ করেই ৩১টি করিডর এলাকায় তা শিথিল করেছে বিএসএফ। গত মার্চে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা সফর করে গরু চোরাচালান বন্ধের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর ভারত থেকে গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকায় ঢুকছে গরু : দুই দিন ধরেই ঢাকায় ঢুকছে ট্রাকে ট্রাকে গরু। কোরবানির পশুর হাটগুলোয় দেশি-বিদেশি গরু হাজির করা হচ্ছে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী অঞ্চল থেকে গরু আনা হচ্ছে নৌকাযোগে। ট্রাকের ভাড়া অত্যধিক হওয়ায় গরুর বেপারিরা বড় বড় নৌকায় শতাধিক গরু তুলে পদ্মা-যমুনা হয়ে ঢাকার দিকে আসছেন।

এসব নৌকা মানিকগঞ্জের আরিচা-পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় নামিয়ে ট্রাকে তুলে ঢাকায় আনা হচ্ছে।রাজধানীতে কোরবানির পশুর অস্থায়ী হাটগুলো প্রায় প্রস্তুত। বাঁশ দিয়ে খুঁটি গেড়ে প্রস্তুত করা হয়েছে হাটগুলো। ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটগুলোয় পশু আসতে শুরু করেছে। হাট জমতে আরও কয়েক দিন লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোরবানি উপলক্ষে ঢাকায় বাড়তে শুরু করেছে গরু আমদানি। মহিষ, ছাগল, ভেড়ার আমদানিও হচ্ছে ব্যাপক। এ তালিকায় বাদ থাকছে না উট ও দুম্বা।

বেপারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগের তুলনায় গরুবাহী প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া বেশি এবং পথে পথে চাঁদাবাজির কারণে এবার গরুর দাম কিছুটা চড়া হবে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, পাবনা, মেহেরপুরসহ উত্তরবঙ্গ থেকে বর্তমানে গরুবাহী প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া গড়ে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা। ১৫-১৬টি গরু পরিবহন করা যায় একেকটি ট্রাকে। কোরবানির সময় এসব গরুবাহী ট্রাকের ভাড়া এক লাফে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ ছাড়া পথে পথে নানা ধরনের চাঁদাবাজিসহ হাট-খরচ তো আছেই।

বেপারিরা জানান, সারা বছর যে ট্রাকের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা, কোরবানির আগে তার ভাড়া গিয়ে দাঁড়াবে ৩০ হাজারে। পথে পথে চাঁদাবাজি, মস্তানি ও হাট-খরচ তো বাদই থাকল। এখনো গৃহস্থের কাছ থেকে চড়া দামে গরু কিনতে হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন গরু ব্যবসায়ীরা।-বিডিপ্রতিদিন
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে