নিউজ ডেস্ক : ইতিহাসের এ এক অন্যরকম উৎসব। জমকালো, রঙিন আয়োজন। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষার্থী- শামিল ছিলেন সবাই। নানা রঙে সেজেছিল রাজপথ। হাতি আর ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করেছিল ভিন্ন এক আবহ। সমাবেশ হয়েছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান)।
যেখান থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনতার সাগরে রাজনীতির কবির দেয়া সে ভাষণ ইতিহাসে স্থান নিয়েছে বহু আগেই। জনতার হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া সেই রাজনীতির মহাকাব্যের মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
ইউনেস্কোর সেই স্বীকৃতি উদযাপন উপলক্ষে গতকাল দেশজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। স্বীকৃতি উদযাপনের দিনে গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফিরে এসেছিল আবারো সেই দিন। সরকারি আয়োজনের অংশ হিসেবে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশে পালিত হয় নানা কর্মসূচি। ঢাকায় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত হয় আনন্দ শোভাযাত্রা।
এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, চিকিৎসক-নার্স, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। ব্যতিক্রমী এ আয়োজনে গতকাল লোকারণ্য ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশেপাশের এলাকা। দুপুরের পর থেকে রঙ-বেরঙের ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে লোকজন জড়ো হতে থাকেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনস্রোত। বাদ্যযন্ত্রের তালে শোভাযাত্রা যখন উদ্যানে এসে পৌঁছে তখন পুরো উদ্যান যেন জনসমুদ্র। বিকাল তিনটায় শুরু হওয়া সমাবেশও ছিল অনেকটা ব্যতিক্রম। প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চে ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে বক্তব্য দিয়েছেন শুধু মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব।
সমাবেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম স্বাগত বক্তব্য রাখেন। ৭ই মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সমাবেশে আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা ছিলেন অতিথি সারিতে। বিকাল তিনটা ২০ মিনিট। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ শুরু করেছিলেন সেই ক্ষণে বাজানো হয় ঐতিহাসিক সেই ভাষণ।
এরপর বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২২ মিনিটের বক্তব্যে তিনি তুলে ধরেন ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপট। প্রধানমন্ত্রী যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন পুরো উদ্যান লোকে- লোকারণ্য। উদ্যান ছাপিয়ে জনস্রোত দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষে পরিবেশিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এর আগে দুপুর ১২টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পুষ্পস্তবক অর্পণ করার মধ্য দিয়ে সরকারি উদ্যোগে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির এই উদযাপন শুরু হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পর একে একে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোজাম্মেল হক খান, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, আইজিপি একেএম শহীদুল হকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। ৩২ নম্বরে পুষ্পস্তবক অর্পণ পর্ব শেষ হওয়ার পর সেখান থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
শোভাযাত্রার সামনে ছিল হাতি আর ঘোড়ার গাড়ি, এরপর সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকটি ট্রাক। এরপর একে একে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা, বিআইডব্লিউটিসি, পর্যটন করপোরেশন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ব্যানার- ফেস্টুন নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন।
তাদের হাতে থাকা ব্যানার-ফেস্টুনে ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায় রাখতে পারবা না’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’সহ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের বিভিন্ন অংশ লেখা ছিল। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ছিল ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান।
বিকালে সমাবেশ হলেও দুপুরের দিকে সোনারগাঁও হোটেল মোড় থেকে শাহবাগগামী সড়ক মৎস্য ভবন পর্যন্ত আটকে দেয়া হয়। যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় শেরাটন মোড় থেকে কাকরাইল পর্যন্ত। শাহবাগ থেকে কাঁটাবন, দোয়েল চত্বর, ঢাকা মেডিকেল সড়কও বন্ধ ছিল। এসব সড়কে সমাবেশে আসা লোকজনকে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
এদিকে সমাবেশ ঘিরে পুরো এলাকা ছিল ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার নজরে। পুলিশের পাশাপাশি পিজিআরের (প্রেসিডেন্সি গার্ড রেজিমেন্ট) সদস্যরা সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। প্রবেশকারীদের মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে দেহ ও ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। নারীদের জন্য আলাদা নারী পুলিশ দিয়ে তল্লাশি করা হয়।
শৃঙ্খলার স্বার্থে সমাবেশে আসা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। র্যাব-৩ এর পক্ষ থেকে মাঠের মধ্যে ২টি ওয়াচ টাওয়ার বসানো ছিল। র্যাবের সদস্যরা সেখান থেকে চারপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।
এদিকে ৭ই মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি উদযাপন উপলক্ষে শনিবার সরকারের পক্ষ থেকে জেলা ও উপজেলায় শোভাযাত্রা-সমাবেশের কর্মসূচি পালিত হয়। এতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন। পূর্ব নির্ধারিত এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। -এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস