শনিবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:৫৪:৪৩

যেভাবে পরিবর্তনের ঢেউ তুলেছিলেন স্বপ্নবাজ আনিসুল হক

যেভাবে পরিবর্তনের ঢেউ তুলেছিলেন স্বপ্নবাজ আনিসুল হক

জয়শ্রী ভাদুড়ী : ‘আমরা এমনভাবে ফুটপাথ তৈরি করেছি যাতে একজন অন্ধ মানুষ বা প্রতিবন্ধী মানুষ নির্বিঘ্নে চলতে পারেন। সারা বিশ্ব থেকে লোকজন আমাদের রাস্তা-ফুটপাথ দেখতে আসবেন। শহর অনেক নিরাপদ হয়ে যাবে। ঢাকা শহর বদলে যেতে শুরু করেছে। আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, কে কোন কাজ করছেন তার সব আমি জানি।’

মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছর পূর্তির প্রাক্কালে গত ২২ এপ্রিল এক সাক্ষাৎকারে ঢাকাকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই মৃত্যুর হাতে জীবন সপে দিলেন স্বপ্নবাজ মেয়র আনিসুল হক।

ঢাকাকে স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে মেয়র আনিসুল হকের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আনিসুল হক ঢাকাকে বদলে দিতে অসংখ্য প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, যেগুলোর বেশকিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাকে খুব কাছে থেকে জানার সুযোগ হয়েছিল।

মেয়রের কাজের বাইরে গিয়ে তিনি যানজট নিরসনে মহাখালী-গাজীপুর পর্যন্ত ইউলুপের প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে চার হাজার বাস নামানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। শাহাবুদ্দিন পার্ক, বনানী পার্ক ও মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড মাঠে পার্কের নকশা আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন।

এ ছাড়া ৮৭টি পার্কের জন্য কনসালট্যান্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করে আনছিলেন। তিনি হাতিরঝিলের মতো আরও তিনটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। উত্তরার দিকে জলনিসর্গ নামে প্রকল্প ছিল তার। এ ছাড়া কল্যাণপুরের পেছনে গিয়ে গাবতলীর পাশে এবং রামপুরা কাটাসুর খালকে কেন্দ্র করে প্রকল্পের অনুমোদন প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

এতে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশে বিনোদন কেন্দ্র পেত নগরের মানুষ। জলাধার সংরক্ষণে বিশেষ নজর ছিল তার। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আনিসুল হক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মোবাইল লাইব্রেরির অনুকরণে মোবাইল স্কুল খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। তার মৃত ছেলে সারাফের নামে তিনি এ প্রকল্পের নামকরণ করেছিলেন। ঢাকার সব স্তরের মানুষই ছিল মেয়রের পরিকল্পনার ভিতরে।

সবাইকে নিয়ে স্মার্ট ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা ছিল তার। ঢাকার নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ২৬টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন আনিসুল হক। গার্মেন্ট শ্রমিকদের নামমাত্র সুদে ঋণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা হাতে নিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে তিনি তিনটির অনুমোদন পেয়েছিলেন। এর একটি ছিল তার নিজের প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী গ্রুপ। এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে স্থায়ী বাসস্থান পেত অবহেলিত মানুষগুলো।

স্মার্ট নগরীর পরিকল্পনার বিষয়ে ইকবাল হাবিব বলেন, নাগরিক সুবিধা সহজ করতে স্মার্টকার্ড দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন মেয়র আনিসুল হক। ডিজিটাল কার্ডে নাগরিকদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে খুব দ্রুত সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি। একটি নিরাপদ, আধুনিক ও নারীবান্ধব মহানগর গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে ২০১৫ সালের ৬ মে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব নেন আনিসুল হক।

সিটি মেয়রের দায়িত্ব নিয়েই রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেন তিনি। রাজধানীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নগরবাসীর হৃদয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন আনিসুল হক। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সেনা সমর্থিত সরকার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তার মোড় থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড, গাবতলীতে ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে না পারলেও মেয়র হিসেবে তা উচ্ছেদ করে দেখিয়েছেন তিনি। শুধু উচ্ছেদই নয়, এগুলো সরিয়ে রাস্তা সংস্কার করে দিয়েছেন নগরবাসীর সুবিধার্থে।

কূটনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গুলশান-বারিধারার নিরাপত্তা জোরদার, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোর দখলে থাকা ফুটপাথ জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা, গুলশান-বনানী এলাকা থেকে পুরনো বাস সরিয়ে ‘ঢাকা চাকা’ নামের নতুন এসি বাস সার্ভিস চালু, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, ‘সবুজ ঢাকা’ নামের বিশেষ সবুজায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে নাগরিক মহলে বিশেষ প্রশংসিত হন তিনি।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ফিরিয়ে এনেছেন জনগণের সম্পত্তি। নগরীকে নিরাপদ করতে তার উত্তর সিটি এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগিয়েছেন তিনি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সমস্যায় দিনে-রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নাগরিকবাসীর আস্থাভাজন হয়েছেন মেয়র আনিসুল হক। যে কোনো নতুন ভাবনা মাথায় এলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে তার উপযোগিতা যাচাই করতেন তিনি।

তার অসংখ্য কাজে মতামতের জন্য যোগাযোগ করতেন নগরবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের সঙ্গে। আনিসুল হকের ঢাকা নিয়ে স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে এ স্থপতি বলেন, শুনতে অভাবনীয় লাগলেও কথাটা সত্যি, মেয়র হওয়ার আগেই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করেছিলেন আনিসুল হক। মেয়র নির্বাচিত হলে নগরের উন্নয়নে কোন বিষয়গুলোয় আগে হাত দিতে হবে তা স্থির করে রেখেছিলেন আগেই।

নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে ঢাকাকে বিশ্বমানের নগর হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। রাজধানীর যানজট নিরসনে ছয়টি কোম্পানির মাধ্যমে পরিবহন খাতকে প্রায় গুছিয়ে এনেছিলেন। এখন জানি না কতটুকু কী হবে। মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি করেছিলেন ফুটপাথের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে। উচ্ছেদ অভিযানে কোনো বাছবিচার করতেন না তিনি। আগে ফুটপাথ থেকে লাফ দিয়ে নামতে হতো। আর এখন নবনির্মিত ফুটপাথ দিয়ে চোখ বন্ধ করে হেঁটে যাওয়া সম্ভব।

নগরীকে সবুজ করে গড়ে তুলতে প্রথম শাহীন স্কুলের সামনে ফুটওভার ব্রিজে গাছ লাগিয়েছেন আনিস। এরপর এ প্রকল্প এগিয়ে নিতে আমাদের সঙ্গে, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে বার বার আলোচনা করেছেন তিনি। শুধু ফুটওভার ব্রিজ নয়, ছাদ বাগান করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের গাড়ির মাধ্যমে গাছ, মাটি পৌঁছে দেওয়া হতো ছাদ বাগান আগ্রহীদের হাতে। ঢাকা শহরকে নতুন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি।

শহরের উঁচু দেয়াল ভেঙে দিয়ে আকাশ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন মেয়র আনিসুল হক। ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দর রোডে উঁচু দেয়াল ভেঙে দিয়ে সবুজায়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন তিনি। বিমানবন্দরের চারপাশে সাইকেল লেন করার চিন্তা ছিল তার। অনেক কিছু তার এখতিয়ারে না থাকলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে।

এত নিখুঁতভাবে কাজ করার পরিকল্পনা এর আগে কারও দেখিনি। তার পরিকল্পিত কাজগুলো যদি তিনি শেষ করে যেতে পারতেন তাহলে সত্যিই তিলোত্তমা হতো ‘আমার ঢাকা’। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই গত বৃহস্পতিবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন নগরবাসীর আস্থা-ভরসার মানুষ ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক। বিডি প্রতিদিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে