শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৫, ১২:৩১:৩৫

ঐশীর ফাঁসি কি সমাজের গভীর ক্ষত শুকাবে?

ঐশীর ফাঁসি কি সমাজের গভীর ক্ষত শুকাবে?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : সম্প্রতি শিশু রাজন, রাকীব হত্যার দ্রুত বিচার হয়েছে।নারায়নগঞ্জের বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডারেরও দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমানের হত্যাকারী তাদের মেয়ে ঐশী রহমানকেও ফাঁসি দেয়া হয়েছে।এর মধ্যে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজের নীতিনির্ধারকরা এক অফুরন্ত আনন্দের উৎস খুঁজে পাচ্ছেন বলে তাদের কথা-বার্তায় প্রতীয়মান হচ্ছে।সর্বত্রই যেন আনন্দের উচ্ছ্বাস বইছে।আসলে বিষয়টি কী এতটা খুশির হবার মত? সমাজে কোনো ধরনের হত্যাকান্ডই কারো কাম্য নয়।আর যে কোনো কারণে হত্যাকান্ডের মত গুরুত্বর অপরাধ সংঘটিত হলে এর দ্রুত বিচার চান সবাই।সম্প্রতি রাজন-রাকিব ও পুলিশ দম্পতি হত্যার দ্রুত বিচার নিঃসন্দেহে সমাজের জন্য ইতিবাচক দিক। ডাবল মার্ডারের দায়ে দেশের প্রচলিত আইনে এমন শাস্তিই ন্যায় বিচার।এ নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। তবে প্রশ্ন উঠেছে- ঐশী যে অপরাধ করেছে এর জন্য কি সে একাই দায়ী, না আমাদের সমাজেরও দায় রয়েছে? ব্যক্তিগতভাবে ঐশীর ফাঁসির রায় শুনে মর্মাহত হয়েছি।কেননা, ঐশী তো অন্য শিশুদের মত নিষ্পাপ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল।কিন্তু তার এই নৈতিক অধঃপতন হলো কেন?তার এই অধঃপতনের দায় কি আমরা এড়াতে পারি, এ জন্য কি আমাদের সমাজ দায়ী নয়?বিশেষ করে গোটা সমাজ এবং ঐশীর পরিবার, যাদের দায়িত্ব ছিল তাকে সঠিক পথ দেখানো।তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই আজ ঐশীর এই পরিণতি।ঐশীকে তার মা-বাবা সঠিকভাবে লালন-পালন করেননি।সে মাদকে আসক্ত হয়েছে।অথচ অভিভাববক হিসেবে ঐশীর পরিবার মেয়ের এই অবক্ষয় ঠেকাতে পারেননি।এ কারণে ঐশীর এই করুণ অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য দায় তার পরিবারেরও।তারা এ দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। অন্যদিকে আমরা যখন লক্ষ্য করছি- উন্নত দেশগুলোতে যেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের ক্ষেত্রে পেনাল রিফর্ম করা হচ্ছে, যেখানে বয়স্কদের ক্ষেত্রেও মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কমানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।এমন কি বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান উঠিয়ে দিয়েছে, সেখানে ঐশীর মতো একটি মেয়ে, যে কিনা সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে, তার শাস্তি হয়েছে মৃত্যুদণ্ড, এটি মেনে নেওয়া কষ্টকর। ঐশী মাদকাসক্ত হয়ে নৈতিক অধঃপতনে তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে।আর এই একবিংশ শতাব্দীর সভ্য সমাজে আইনের বলে আমরা সবাই মিলে তাকে হত্যা করবো?এটা কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারছি না।আমরা আশা করবো, উচ্চ আদালত ঐশীর রায় পুনর্বিবেচনা করবে।সেই সাথে বিচারকরা এ ধরনের অবক্ষয় রোধে আমাদের সমাজকে একটা দিক নির্দেশনা দেবেন। আজকে যারা ঐশীর ফাঁসির রায়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন তারা কি মনে করেন এর মাধ্যমেই আমাদের সমাজের গভীর ক্ষত শুকিয়ে যাবে?না, এই ঐশী আমাদের সমাজের গভীর ক্ষতের প্রতীকী রূপ।তার ঘটনা সমাজের মধ্যে থাকা দীর্ঘদিনের একটি গভীর ক্ষতকেই কেবল সামনে এনেছে।একে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না।এ ঘটনা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাদকাসক্ত, হতাশা, বিপথগামী যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে; তেমনি অনেক পরিবারের, বিশেষ করে বাবা-মায়ের অসচেতনতা ও সন্তান লালন-পালনে ব্যর্থতাকেও সমানভাবে সামনে এনেছে। আমরা জানি, উন্নত বিশ্বের যে কোনো সমাজে সমস্যা দেখা দিলে তা নিয়ে গবেষণা হয়, বাহ্যিক দিকের চেয়ে গভীরের কারণ খোঁজা হয় এবং তা সমাধানের পথ খুজেঁ বের করার চেষ্টা করা হয়।সেই আলোকে আমি মনে করি, আজ আমাদের সামজে অপরাধ প্রবণতার মত একটি গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে।ফলে প্রকৃত সমস্যা খুঁজে বের করে তা স্থায়ী সমাধানের লক্ষে একটি উচ্চমানের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।অন্যথায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা আরো বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। তাই সমাজকে এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তার সময় এসেছে।সমাজকে ভাবতে হবে আমাদের শিশু-কিশোররা কেন বিপদগামী হচ্ছে, কেন তারা স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে দেশ-জাতির স্বার্থে ভুমিকা রাখতে পারছে না, কেন অকালে বিপদগামী হচ্ছে।কোথায় গলদ?তা আমাদেরকে খোঁজে বের করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র-সমাজকে ভুমিকা রাখতে হবে।তবেই আশা করা যায় ঐশীর মত আর কোনো কিশোর-কিশোরী এমন বিপদগামী হবে না।সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। আর দু-চারটি হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার সম্পন্ন হয়েছে বলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এমন আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই।কেননা, দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের সমাজের রন্ধে রন্ধে ঢুকে গেছে অপরাধ।আর সেটা ক্রমেই গ্রাস করছে সমাজকে।এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক নয়। কেননা, আইন মন্ত্রনালয়ের দেয়া তথ্যমতেই, বর্তমানে বাংলাদেশে ২৮ লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।এর মধ্যে ৬০ শতাংশই ফৌজদারি মামলা।অর্থাৎ হত্যা-খুন, নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকতি ও রাহাজানিসহ নানা ধরনের মামলা।অনেক হত্যা মামলা ১০ থেকে ২০ বছর ধরেও বিচারলয়ে ঝুলে আছে।স্বজনরা ঘুরে ঘুরেও বিচার পাচ্ছেন না।তাই দু-চারটি হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার নিয়ে আত্মতৃপ্ত না হয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে। লেখক: শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল: [email protected] (লেখকের একান্তই নিজস্ব মতামত, এমটিনিউজ২৪ডটকমের সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয়) ১৩ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে