মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০১:০৪:৩৭

তখনকার আর এখনকার রাজনীতি : কাদের সিদ্দিকী

তখনকার আর এখনকার রাজনীতি : কাদের সিদ্দিকী

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : ১২ রবিউল আউয়াল রসুলে করিম (সা.)-এর জন্ম এবং মৃত্যুদিন। একজন মুসলমানের জন্য শ্রেষ্ঠ দিন। এবার ১১ রবিউল আউয়াল ছিল পবিত্র জুমা। খুতবার একপর্যায়ে ইমাম বললেন, ‘আমরা জৌলুস করব না, ঘরের কোনে ইবাদত করব, আল্লাহ-রসুলের নাম নেব।’

যারা জৌলুস বের করবেন এক অর্থে তিনি তাদের নিন্দাই করলেন। তবু সোমবারের পত্রিকায় বিশাল জৌলুস দেখলাম। আমার কাছে খারাপ কিছু মনে হয়নি, বরং ভালোই মনে হয়েছে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব, আমাদের শেষ পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিনে রাস্তায় শান্তিপূর্ণ মিছিল করব না, তো কী করব।

মৃত্যু মানুষকে মহান ও বড় করে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। সর্বশেষ আনিসুল হক দুই-আড়াই বছর ঢাকা উত্তরের মেয়র। কর্মজীবনে রাজনীতি করেননি। ছাত্রজীবনে আওয়ামীবিরোধী ছাত্র সংগঠনে ছিলেন। মারা গেলেন আওয়ামীপন্থি হয়ে।

তার মৃত্যু পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে আশাতীত স্থান পেয়েছে। মৃত্যুর পর আনিসুল হকের প্রতি জাতির দেখানো সম্মান মনে রাখবার মতো। সবাই মর্মাহত। আমার বুকেও যে আঘাত করে না, তা নয়। ভদ্রলোক আমাকে ভীষণ সম্মান করতেন। এমন কোনো সময় ছিল না সহযোগিতা চেয়ে কাউকে পাঠালে খালি হাতে ফেরত দিয়েছেন। এই গত বছরও প্রবল বন্যায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সহযোগিতা চেয়েছিলাম।

টাকা-কড়িসহ হাজারের ওপর প্যাকেট করা সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড়-সোয়েটার পাঠিয়েছিলেন। যার দু-একশ পড়েছিল যা এবারও লোকজনকে দিয়েছি। এরকম এক প্রিয়জন হারালে কার না হৃদয়ে বাজে। কিন্তু যখনই দেখি যাকে সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম, রাজনৈতিক নেতা ও পিতা বলে গ্রহণ করেছিলাম তার মৃত্যু, যার জানাজায় তিল ধরার জায়গা থাকার কথা ছিল না, দেশ-পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

তার নির্মম নিষ্ঠুর মৃত্যুতে দাফন-কাফন করানোর পরিবেশ না থাকায় ১৭-১৮ জনের বেশি লোক ছিল না। তাদের মধ্যে এখন তিন-চারজন যারা বেঁচে আছেন তাদের কেউ খোঁজখবর করি না। বড় বিপদে পড়ে মুন্নীর বাবা সোহরাব আলী সে দিন এসেছিলেন। তাকে দেখে ভীষণ খারাপ লেগেছে। বঙ্গবন্ধুকে শেষ গোসল করিয়ে কবরে নামানো, জানাজা পড়া এসবের বয়সীদের মধ্যে শেষ সাক্ষী তিনি।

ইদ্রিস বা ইসহাক নামে আর দুজন যারা আছে তারা তখন ছিল খুবই ছোট। শরিয়তমতো বোধহয় জানাজায় দাঁড়াবার বয়সও ছিল না। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, ঝোঁকে বাঙালি। আমার কখনো বিশ্বাস হতো না। কারণ সারা জীবন কখনো ঝোঁকে মাতিনি। হৃদয় যে নির্দেশ দিয়েছে, বিবেক যে পথে নির্দেশ করেছে, সব সময় সে পথই ধরেছি। কখনো সখনো ন্যায়-সত্য মনে করে বন্ধুর বিপক্ষে শত্রুর পক্ষে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু শেষ বয়সে কেন যেন বিবেক-বিবেচনা মন-মনন ঝোঁকের দিকে প্রবল বেগে টেনে চলেছে।

মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আমার বিবেচনায় জিয়াউর রহমান যদি ওই সময় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত না হতেন তার দলে এবং দেশে যে খাওয়া-খাওয়ি শুরু হয়েছিল, বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের হত্যার পর তার লাশ যখন অজ্ঞাত স্থানে পুঁতে রেখেছিল, তখন রাজধানী ঢাকায় ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী এবং তিতুমীর কলেজের আনিসুজ্জামান খোকন মিছিল নিয়ে বেরোনোয় বিএনপির অনেক নেতাই ইঁদুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে মহাবীর আলেকজেন্ডার অথবা নেপোলিয়ন বোনাপাট সেজেছিলেন।

অন্যদের মতামত কী জানি না, আমার মতে জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু খালেদা জিয়া তাকে লালন-পালন করে সাবালক করেছেন। আনিসুল হককে নিয়ে ভালোমন্দ একটা কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। কিন্তু আজ নয়। কারণ একজনকে নিয়ে লিখতে গেলে আনন্দ-বেদনা দুই-ই থাকবে, আশা-হতাশা হাত ধরাধরি করে, গলাগলি করে এগিয়ে যাবে।

তাই পরিবেশ শান্ত হোক নিরাসক্তভাবে তাকে যেভাবে জানি, চিনি সেভাবে একটি লেখা লিখব। আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের কাছে প্রার্থনা, তিনি তাকে বেহেশতবাসী করেন, তার পরিবারকে ছায়া দেন। গত লেখা বেরোবার পরপরই মনে মনে একটি লেখা তৈরি করে রেখেছিলাম। পরের দিন অথবা তারপর দিন লেখাটি তৈরি করে ফেলতে চেয়েছিলাম।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি না করলে দেশের দুর্নীতি অর্ধেক আপনা-আপনি শেষ হয়ে যাবে।’ বাহ্যিক দৃষ্টিতে তার কথার অবশ্যই যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার কথাটি সঠিক নয়। আসলে এখন প্রকৃত রাজনীতিবিদরা রাজনীতিতে নেই। প্রকৃত রাজনীতিকরা রাজনীতিতে থাকলেও তারা ক্ষমতা ও গুরুত্বহীন এবং কোনো দুর্নীতি করে না।

কারণ তাদের রাজনীতিতে যেমন গুরুত্ব নেই, দুর্নীতি করারও ক্ষমতা নেই। এখন রাজনীতি পরিচালনা করে অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী বা অন্যান্য ব্যক্তিরা। অরাজনৈতিক লোকজন রাজনীতির মাঠ ভরে ফেলে রাজনীতিকে কলুষিত করছে। এখনো তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যারা আগাগোড়া রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা এখন নিঃস্ব সর্বস্বান্ত। আমাদের নেতারা রাজনীতিতে টু-পাইস কামানো যায় এটা ভাবতেও পারতেন না। এসব ছিল তাদের চিন্তার অতীত।

আমরাও সেই ধারাবাহিকতায় চলার চেষ্টা করেছি। কমিটি গঠন, রাজনৈতিক পদ অদলি-বদলি এসব করে টাকা-পয়সা পাওয়া যায় আমাদের চিন্তায় ছিল না। প্রতি বুধবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে পীর হাবিব লিখে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পথ ধরে পীর হাবিব দুর্নীতি নিয়ে চমৎকার একটি লেখা লিখেছে। বহু পাঠকের সঙ্গে আমাকেও নাড়া দিয়েছে।

তার লেখার সঙ্গে প্রায় সবটুকুই একমত। কিন্তু দ্বিমত পোষণ করি, প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এখনো দুর্নীতির পাঁচ ভাগও করে না। কারণ দুর্নীতি এমন একটা কলাকৌশল তা শিখতে হয়, চরিত্র হারাতে হয়, বিবেক-বিবেচনা, ন্যায়-সত্যকে বর্জন করতে হয়। এখনো সবাই সে সব পারে না। সে সবের জন্য যতটা খেলো বিবেকহীন হতে হয় সামান্য রাজনীতি করলেও সহজে তেমন হওয়া যায় না।

রাজনীতির একটা মহিমা আছে। রাজনীতি ভালোবাসা জাগায়, মানবতা জাগায়, সম্মান ও মর্যাদাবোধ জাগায়। একটা চরিত্রহীন অথর্বের চাইতে সাধারণ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তৃণমূল পর্যায়ের একজন কর্মীর মেরুদণ্ড অনেক শক্ত, অনেক চনমনে। রাজনীতির সঙ্গে উঠাবসা যে কোনো মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ অনেক বেশি। তাই রাজনীতিবিদ নয়, রাজনীতিক কর্মকাণ্ড অনেক ক্ষেত্রে কলুষিত হয়ে গেছে।

ধুয়ে-মুছে ঝাড়পোছ করে রাজনীতি কিছুটা কলুষমুক্ত করা গেলে এবং দলে কর্মীদের মতামতের প্রাধান্য পেলে ভোটার নির্বিঘ্নে তাদের ইচ্ছামতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারলে দেশের অর্ধেক দুর্নীতি আপনা-আপনি যে বন্ধ হয়ে যাবে, এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু ঢালাওভাবে রাজনীতিকরা দুর্নীতি করে—এ বক্তব্যের সঙ্গে কখনো একমত পোষণ করতে পারি না। আগে রাজনীতিকরা রাজনীতি করত। রাজনীতি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ছিল।

এখন বেশিসংখ্যক দুর্নীতিবাজরা শক্তি ও অর্থের বলে রাজনীতি দখল করে আছে আর রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাত থেকে বেদখল হয়ে গেছে। ভোটারের ভোট নেই, রাজনীতিবিদদের রাজনীতি নেই। তাই দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে আছে। কৃষক যখন খেত বাঁচাতে বেড়া দেয়, সেই বেড়ায় খেত খেলে কৃষকের কিছু করার থাকে না, তেমনি রক্ষক ভক্ষক হলে দুর্নীতির গলা টিপে ধরা যায় না। যে গলা টিপে ধরবে সেই যদি দুর্নীতি করে তাহলে তার গলা টিপবে কে?

এরকম সমস্যা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ দুর্নীতি এবং যেভাবে তা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে তার তুলনায় রাজনীতি একেবারেই ম্রিয়মাণ। রাষ্ট্র হয়েছে একমুখো। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বা ইচ্ছা ছাড়া কোনো কাজ হয় না—এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ সেই কবে শুনেছি ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’—সব এখন উল্টো স্রোতে। স্রোতের গতি এত প্রবল বাস্তব সত্য তলিয়ে যাচ্ছে।

ছোটবেলায় নদীর পাড়ে অনেক সময় অনেক ছোট গাছ-গাছড়া দেখেছি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কূলে কূলে বয়ে যাওয়া স্রোত তার আশপাশ দিয়ে চলে যায়। স্রোতের টানে সে তার মাথা ঝাঁকাতে থাকে, কিন্তু নুইয়ে পড়ে না। কিন্তু এক সময় পানি বাড়তে বাড়তে তার মাথা স্পর্শ করতে চায়, তখন সে কখনো পানির তলে নুইয়ে পড়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।

প্রবল স্রোত এসে আবার তাকে তলিয়ে দেয়, আবার সে উঠে দাঁড়ায়। ২-৪-১০ ঘণ্টায় পানি কমে গেলে সে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু পানি যদি না কমে আরও বাড়তে থাকে এবং ২-৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয় তাহলে সে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। চারদিক থেকে পলিমাটি এসে তাকে কবর দিয়ে দেয়।

আমাদের রাজনীতিরও অনেকটা তেমন হয়েছে। এখনো কখনো কখনো প্রকৃত রাজনীতি সবকিছু কাটিয়ে মাথা তুলে উঠতে চায়, দু-এক ক্ষেত্রে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এই দুর্নীতি যদি অনেক ওপর দিয়ে বয়ে চলে মাথা নুইয়ে যায়, দীর্ঘস্থায়ী হলে চাপা পড়ে। তখন আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না, সব শেষ হয়ে যায়। বিডি প্রতিদিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে