মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০১:০৯:২৫

৫ ডিসেম্বর ঢাকা দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম : বীরউত্তম সফিউল্লাহ

৫ ডিসেম্বর ঢাকা দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম : বীরউত্তম সফিউল্লাহ

কে এম সফিউল্লাহ, বীরউত্তম : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম যুবক। অল্পবয়স্ক। দেশ স্বাধীন করতে রক্ত দিতে দ্বিধা ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা আমাদের নিজ নিজ কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এই সুযোগে আমাদের একটা যে ছোট প্রতিপক্ষ ছিল জামায়াতে ইসলামী, আলশামস ও রাজাকার— তাদের কর্মকাণ্ড আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। এই সুযোগে তারাও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

আমাদের যে কাজটা করা উচিত ছিল, সেই কাজটা করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম সেই কাজটাই হাতে নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের যে যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের বিচারের সম্মুখীন করে আমাদের ব্যর্থতা ও দায় মোচনে অগ্রসর হতে হবে। এতে তরুণ প্রজন্ম ফলপ্রসূ হবে বলে আমার বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ ডিসেম্বর আমরা সবাই ঢাকা দখলের সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়েছি।

এ সময় বঙ্গোপসাগরে মার্কিনিদের সপ্তম নৌবহর আসতে থাকে। জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অষ্টম নৌবহর প্রস্তুত রাখে। আমরা ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার আশপাশে অবস্থান করি। ১৬ ডিসেম্বর আমরা যখন চারপাশ দিয়ে ঢাকা অবরুদ্ধ করি তখন পাকবাহিনীর কমান্ডার নিয়াজি আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। এই আত্মসমর্পণে কোনো শর্ত ছিল না। আমি সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সিভিল ও মিলিটারিতে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। সেনাবাহিনীতে আমাদের অংশগ্রহণ ছিল ১ শতাংশের কম। ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ছিল অরক্ষিত। ’৭১-এর নির্বাচনের সময় পূর্ব বাংলায় পাক ও বাঙালি সেনার উপস্থিতি ছিল সমান সমান। ’৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল সামনে রেখে পাক সেনাদের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়তে থাকে।

তাদের সেনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার একটি প্রক্রিয়াও করতে চেয়েছিল। তবে মূলত ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালি সদস্যরা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। ’৭১-এর মার্চ ঘনিয়ে এলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেব না বলে সিদ্ধান্ত নিই।

পাকিস্তানিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিরস্ত্র করতে হবে। কিন্তু আমাদের যুদ্ধপ্রস্তুতি দেখে তারা পিছপা হতে বাধ্য হয়। তারপর আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯ মার্চ জয়দেবপুর সেনানিবাসে আমার নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। বিদ্রোহের পর আমরা সেখানে অবস্থান নিই। ওই বিদ্রোহের পর আমাদের ফোর্স সদস্যরা চাপ দিয়েছিল ঢাকা আক্রমণের। কিন্তু অল্প সেনা দিয়ে আক্রমণে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

তখন পাকিস্তানিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সংলাপে বসেছেন। এই সময়ে আমরা বিদ্রোহ করলে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর দোষ চাপিয়ে তা বিশ্ববাসীকে জানাবে যে, বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করেছে এবং সে বিদ্রোহ দমন করতে তারা সেনা পরিচালনা করেছে। এটা আমরা হতে দিতে চাইনি। বদনামটা যাতে বঙ্গবন্ধুর ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে না পড়ে, সেজন্য অগ্রসর হইনি। বরং আমরা চেয়েছি তারা আক্রমণ করুক। পরে ২৫ মার্চ রাতে আমার সেই সুযোগ আসে।

সেই রাতে ৩০০ জনকে মেরে ফেলে পাকবাহিনী। এদিন রাতে আমার ফোর্সের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী বর্বর হামলা করলে ওই রাতে কোড ওয়ার্ক (গোপন সাংকেতিক শব্দ) দিই, যা ২৯ মার্চ ময়মনসিংহে পৌঁছায়। সেখানে আমরা সবাই জড় হই। একই সঙ্গে আমাদের ব্যাটালিয়নে কিছু পাক সেনা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় আমার হেডকোয়ার্টার্সে একটি কনফারেন্স হয়। সেখানে কর্নেল ওসমানী ছিলেন।

ওই কনফারেন্সে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি কাঠামো ঠিক করি। কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করা হয়। আরও সিদ্ধান্ত হয়, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বলব তারা যেন সরকার গঠন করে। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন সাহেব সরকার গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর সঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেব চারটি আঞ্চলিক কমান্ড ঘোষণা করেন। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান, কুমিল্লায় খালেদ মোশাররফ, সিলেট-ময়মনসিংহে আমাকে ও কুষ্টিয়া-মেহেরপুরে আবু ওসমান চৌধুরীকে।

১৭ এপ্রিল নতুন সরকার গঠন করা হয়। ১০-১৭ জুলাই ওই সরকার (সেক্টর কমান্ডার) একটি কনফারেন্স ডাকে। ওই কনফারেন্সে কমান্ডারদের দিয়ে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে পরিচালিত করতে হবে। তিনটি ফোর্স গঠনে সিদ্ধান্তও তখনই হয়। এই কনফারেন্সের পর আমাদের কর্মকাণ্ড এমন পর্যায়ে যায় যে, অক্টোবর-নভেম্বরে পাকবাহিনী পালাতে পারলেই বাঁচে। আমি আর খালেদ মোশাররফ মিলে যে ফোর্স তৈরি করি তা হলো যথাক্রমে ‘এস ফোর্স’ ও ‘কে ফোর্স’।

এই ‘এস ফোর্স’ তৈরি করার পর আমি প্রথম যুদ্ধ করি আখাউড়ায়। আখাউড়ার যুদ্ধ শুরু হয় ২১ নভেম্বর। তাদের পরাজিত করি ২ ডিসেম্বর। সেই যুদ্ধে আমরা মুকুন্দপুর থেকে আখাউড়া পর্যন্ত পুরো এলাকা দখল করে আখাউড়ায় বসেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছি। ভারতও সেদিন মিত্রবাহিনী নামে আমাদের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নভেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে জয়েন্ট কমান্ড ফোর্স গঠন করা হয়। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফোর্সের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল অরোরাকে।

এরপর পাকিস্তানিদের অবস্থান খারাপ হওয়ায় আমেরিকা তাদের পরামর্শ দেয় ভারতকে যুদ্ধে নামানোর জন্য। তাদের পরামর্শে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর পেছনে ছিল মার্কিনিদের গভীর ষড়যন্ত্র। তারা চেয়েছিল আমরা যেন গুলি করা বন্ধ করি। আমরা বলেছি, গুলি বন্ধ করব, তারা যদি শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই বিষয় নিয়ে জাতিসংঘে বিতর্ক হয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনবার ভেটো দেয়।

আমরা দেখেছিলাম আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আমরা পৌঁছানোর আগে ঢাকা দখল যেন তারা না করতে পারে সেজন্য ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার আশপাশে অবস্থান নিই এবং ১৬ ডিসেম্বর সকালে ডেমরার যেই ব্যাটালিয়ন যুদ্ধ করছিল, তারা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেখান থেকে আমাকে বলা হয় বিমানবন্দরে জেনারেল অরোরাকে যেন রিসিভ করি বিকাল সাড়ে ৩টার আগে।

আমার কাছে তখন গাড়ি ছিল না। ওই ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলি এবং সেই গাড়ি আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়। কিছুক্ষণ পরই জেনারেল অরোরা তার দলবল নিয়ে হেলিকপ্টারে নামেন। তাদের স্বাগত জানিয়ে ঢাকায় বিকাল সোয়া ৪টায় রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই এবং সেখানেই নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন। -বিডি প্রতিদিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে