কাজী হায়াৎ : ‘সদা সত্য কথা বলিও, সৎ পথে চলিও, মা-বাবাকে সেবা করিবে, দুখীজনকে সাহায্য করিবে, অন্ধজনকে পথ দেখাবে, গুরুজনকে মান্য করিবে, এতিমের সম্পদ হরণ করিবে না, সুদ গ্রহণ অন্যায়, অপরের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন, জবরদখল অথবা আত্মসাৎ চরম অপরাধের। মানুষের সেবা করিবে, যেজন সেবিছে মানুষ সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। মানুষ হত্যা মহাপাপ।’
জ্ঞান লাভের পর থেকে এমন আরও অনেক কথা শুনে আসছি। সেই কবে পাঠশালায় পড়া থেকে শুরু হয়েছে এসব কথা শোনা। আজও শুনে যাচ্ছি। এসব ভালো কথা শুধু আমি শুনছি না, পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সব মানুষকেই শোনানো হয় এবং তারা শুনেও থাকে।
এসব ভালো কথা পাঠ্যপুস্তকেও আছে। আছে সব ধর্মগ্রন্থে। সব ধর্মেই এ কথাগুলো অমান্য করলে শাস্তির কথাও উল্লেখ আছে। তারপরও ভাবি বয়স ৭১। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ৭২-এ পা রাখব। পৃথিবী দেখা প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে। কী দেখে গেলাম পৃথিবী থেকে। দেখে গেলাম ধর্মীয় উপাসনালয় সে যে ধর্মেরই মানুষ হোক, প্রতিটি মানুষ নিজেকে পাক-পবিত্র করে সেখানে উপস্থিত হয়।
পৃথিবীতে সব সময় ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দেশের কোথাও কোনো যুদ্ধ নেই। অথচ প্রায়ই খবরের মাধ্যমে জানতে পারি এই ধর্মীয় উপাসনালয়ে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষকে। কখনো বোমা মেরে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে মানবদেহ। হাসপাতালে বোমা মেরে, রোগাক্রান্ত রোগীদের মেরে ফেলা হচ্ছে, মারা হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের।
স্কুলে ঢুকে গুলি করা হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু-কিশোরদের। হরহামেশা শুনতে পাই গাড়ি অথবা ট্রাক চালিয়ে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ পথচারীদের। এভাবে মানুষ হত্যা করার কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষ হত্যা করে কোনো ধর্ম বা মতবাদে কাউকে বিশ্বাসী করা যায় না, অথবা কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও দখল করা যায় না। তাহলে কেন এই হত্যাযজ্ঞ?
মানুষ চাঁদে পা রেখেছে। অনেক নতুন নতুন আবিষ্কার করে মানব জাতি যখন গৌরবান্বিত হচ্ছে, তখনই ঘটছে এসব নির্মম ঘটনা। এতে কী মানব জাতির অগ্রসরমান সভ্যতার আলো ম্রিয়মাণ হচ্ছে না? মানুষ সভ্যতার কাছে নিন্দিত অথবা ঘৃণিত কী হচ্ছে না?
পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে যখন খবর শুনতে শিখলাম, তখন থেকেই শুনে আসছি পৃথিবীতে দুটি সমস্যা দারুণ প্রকট। একটি কাশ্মীর একটি প্যালেস্টাইন। এ সমস্যা নিয়ে হয়েছে অনেক যুদ্ধ। প্রাণহানি ঘটেছে অনেক। ঝরেছে টনকে টন রক্ত। তবু আজও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। এর মধ্যে পৃথিবীতে জন্ম হয়েছে অনেক খ্যাতিমান শক্তিধর মহামানবের। অনেকে বিশ্বশান্তির জন্য পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। দারুণ ভাবনা হয় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মহামানবরা কি এসব সমস্যা নিয়ে ভাবেন না?
যেসব জনগোষ্ঠী স্বাধীনতা চায়, সেই অঞ্চলগুলো তো বিশ্বের বাইরের কোনো অংশ নয়। সেখানকার মূল সমস্যাটি কী? সমস্যা তারা স্বাধীনতা চায়। একই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় থেকে যখন ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি, জাতি-গোষ্ঠী অথবা ভাষার কারণে তারা বঞ্চিত হয় তখনই প্রশ্ন আসে স্বাধীনতার। উপরোক্ত কারণগুলো যদি হয় স্বাধীনতা চাওয়ার কারণ তাহলে সঠিক বিবেচনায় তাদের কি কোনো অপরাধ ছিল?
এখন পৃথিবীতে শুধু কাশ্মীর আর প্যালেস্টাইনই সমস্যা নয়। নতুন করে জন্ম হয়েছে আরও অনেক সমস্যা। এখন আরও অনেক ভূখণ্ডের অনেক জনগোষ্ঠী অনেক রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে তারা স্বাধীনতা চায়। স্বাধীনতাকামী চেচেনের দাউদকে মরতে দেখলাম যুদ্ধের বাংকারে। শ্রীলঙ্কায় ভেলুপেল্লাই প্রভাকরণকে দেখলাম জঙ্গলে মৃত অবস্থায়। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেও এরা কুখ্যাত দেশদ্রোহী।
দালাইলামা তার জনগোষ্ঠীর কাছে পূজনীয় ব্যক্তি হয়েও তাকে দেশদ্রোহী হয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। পৃথিবীর কী এমন ক্ষতি হতো, এই স্বাধীনতাকামী মানুষগুলোকে স্বাধীনতা দিলে? আমার তো মনে হয়, অনেক রক্ত, যুদ্ধ, খুন, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্তি পেত পৃথিবী। ছোট্ট একটি জাতি-গোষ্ঠী স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলে তাদের যুদ্ধাস্ত্রের কথা চিন্তা করতে হয় না।
আমার মনে হয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর গণতন্ত্রের পাশাপাশি অবস্থান অনেক সময় পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে। যেমন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সঙ্গে গণতন্ত্রের দারুণ বিরোধিতার কারণে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণতন্ত্রকে মেনে নিয়ে এ দেশের মানুষ ভোট দিল আওয়ামী লীগকে। সেই গণতন্ত্রের রায় মেনে না নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে আপত্তি জানালেন। তখনই প্রশ্ন উঠল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন ঐতিহাসিক বিশ্বনন্দিত ৭ মার্চের ভাষণে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে হলেন দেশদ্রোহী। এ কারণে তাকে চলে যেতে হলো এক অজ্ঞাত জেলখানায়। দেশদ্রোহী হিসেবে তার বিচার শুরু হলো। কিন্তু এদিকে তার ৭ মার্চের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বাঙালিরা অস্ত্র হাতে তুলে মুক্তিযুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনল নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু রাতদিন মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়ালেন যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু জেলখানায় কাটালেন।
যার জন্য বাঙালিরা পেল স্বাধীনতা। সেই বাঙালিই তাকে তার শিশুসন্তানসহ সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করল। তাও দেখে যেতে হলো। রাষ্ট্র আর গণতন্ত্রের বিরোধেই আজ রাখাইনদের পালিয়ে আসতে হচ্ছে বাংলাদেশে। রাখাইনদের রাজনৈতিক মতামত যদি মিয়ানমার মেনে নিত, তাহলে রাখাইন রাজ্যে এত রক্ত ঝরত না। ব্যভিচার আর নির্যাতন হতো না। বনজঙ্গল পার হয়ে নদী সাঁতরে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হতো না।
সেখানকার অবিসংবাদিত নেত্রী তো শান্তিতে নোবেল-জয়ী। কী কী কারণে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হওয়া যায়? মাঝে মাঝে তার কথা ভেবে বিষয়টি দারুণ দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে আমাদের ছোট্ট রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৬ বছরের মধ্যে আমাদের কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়নি। আমাদের কোনো সৈন্যকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লাশ হয়ে স্বজনদের কাছে ফিরে আসতে হয়নি। আমার মনে হয় আমাদের এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির এটি একটি অনন্য নজির।
সর্বশেষ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বিতাড়িত, পালিয়ে বেড়ানো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করে শান্তির পতাকা হাতে তুলে নিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেপণাস্ত্র উক্ষপণের প্রচেষ্টা নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টা স্যাটেলাইট উেক্ষপণ করে মানুষের জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করা। পরমাণু চুল্লি তৈরির প্রচেষ্টা মানুষ হত্যা করার জন্য বোমা তৈরি নয়, আমাদের প্রচেষ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মানুষকে আলোকিত করা। আমাদের রাষ্ট্রনায়কের চিন্তা যুদ্ধ নয়, শান্তি। জয় হোক শান্তির।
যে শান্তির বার্তা এবং উপদেশমূলক কথাগুলো দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম এখানেও তো অনেক শান্তিপ্রিয় মানুষকে কথা বলতে শুনি। তাদের এসব কথা কি কেউ কর্ণপাত করছেন? যেভাবে আণবিক অস্ত্রের ছড়াছড়ি আর মহড়া দেখছি, যেভাবে যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের মহড়া দেখছি, বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের যে ভাষায় বাক্যবিনিময় শুনছি। তাতে ভয় হচ্ছে, পৃথিবীতে যে কোনো সময় মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো দেশে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
ওই সুন্দর কথাগুলো বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব কাদের? বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের এবং সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের। তারা কি তা করছেন? বরং তারাই এই সুন্দর কথা ও উপদেশগুলোকে বোমা আর গুলি করে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তবুও আশা করি, সবারই একসময় বোধোদয় হবে, ভালো কথা এবং উপদেশগুলো একদিন বাস্তবায়িত হবে, একদিন হয়তো এমন হবে কেউ ক্ষমতার কথা ভাববেন না, ভাববেন শুধুই মানব কল্যাণের কথা আর জয় হবে শান্তির। -বিডি প্রতিদিন
লেখক : চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব।
এমটিনিউজ/এসবি