শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:২৪:২৪

১১৪ জনকে হুমকি, তিন বছরেও কেউ শনাক্ত হয়নি

১১৪ জনকে হুমকি, তিন বছরেও কেউ শনাক্ত হয়নি

আসাদুজ্জামান: হাইকোর্টের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক, আইনজীবীসহ গত তিন বছরে অন্তত ১১৪ জনকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ হুমকিদাতাদের শনাক্তই করতে পারেনি। তবে অনেকেরই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। হত্যার হুমকি পেয়ে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন প্রকাশনা সংস্থা ‘শুদ্ধস্বর’-এর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ ওরফে টুটুল। ডায়েরি করার আট মাসের মাথায় গত ৩১ অক্টোবর তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পুলিশ হুমকিদাতা কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি। হত্যাচেষ্টার পরে হামলাকারীদেরও ধরতে পারেনি। ওই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মেজবাহউদ্দিন নিজেও সে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন। হুমকি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিই আছেন ৪১ জন। ৪১ জন আছেন ব্লগার-লেখক। দুটি সাধারণ ডায়েরির সূত্রে এই সংখ্যা জানা গেছে। একাধিকবার হুমকি পেয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ নয়জন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরসহ নয়জন আইনজীবী এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১৩ জনকে গত তিন বছরে হত্যাসহ নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের সূত্রে এঁদের তথ্য জানা গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে এসব হুমকি দেওয়া হয়। আর বিচারপতিদের হুমকি দিয়েছিল হিযবুত তাহ্রীর নামে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। হুমকিদাতাদের পুলিশ কেন চিহ্নিত করতে পারেনি জানতে চাইলে একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে যারা হুমকি দেয়, তারা অনিবন্ধিত মোবাইল সিম ব্যবহার করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হুমকি দিয়েই সেই ফোন তারা আর ব্যবহার করে না। যে কারণে তাদের চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। তারপরও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এরা জঙ্গি নয়, এরা ষড়যন্ত্রকারী। এরা একেক সময় একেক নামে হুমকি দেয়, নিজেদের অবস্থানও পরিবর্তন করেন। এদের খুঁজে বের করা কঠিন। তারপরও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মূলে হাত দিচ্ছেন না। সমস্যা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আসলে মৌলবাদের হাতি ঘরের ভেতরে রেখে বাইরে সুই খুঁজলে চলবে না । শাহরিয়ার কবির,ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তবে ভুক্তভোগী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই কেউ কেউ বলেছেন, হুমকিদাতাদের তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে পুলিশ অতটা আন্তরিক নয়। এমন ধারণার কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, হুমকি পাওয়া ব্যক্তিরা থানায় ডায়েরি করার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডায়েরির যথাযথ তদন্ত হয়নি। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও গণসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে যাঁরা জিডি করেছেন বা নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন, তাঁদের নিরাপত্তার ঝুঁকি মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ গত ২৮ অক্টোবর হাইকোর্টের ৪১ জন বিচারপতিকে লিফলেট পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছে হিযবুত তাহ্রীর। লিফলেটে ‘সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আটক রাখার সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে মুক্তি দাবি’ করা হয়। মুক্তি না দিলে বিচারপতিরা ‘দুনিয়াতে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন’ হবেন বলে বলা হয়। সংগঠনের চিঠি বহনকারী সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের একজন কর্মচারী ছাড়া হুমকিদাতা কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি ডায়েরি করা হয়। প্রথম দফায় ডায়েরি তদন্ত করেন শাহবাগ থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এম এ জলিল। তিনি কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে তদন্ত করেন শাহবাগ থানার বর্তমান পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জাফর আলী বিশ্বাস। দীর্ঘদিন তদন্ত করে গত ১৭ অক্টোবর আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে তিনি জানান, ‘তদন্তকালে হুমকিদাতার নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা যায়নি।’ জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আদালতে কী প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তা আমি জানি না। আমাকে জানানো হয়নি।’ গত ৯ আগস্ট আবার অ্যাটর্নি জেনারেলকে হুমকি দেওয়া হয়। এবারও শাহবাগ থানায় জিডি করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ কাউকে খুঁজে বের করতে পারেনি। হত্যার হুমকি পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও। তিনি বলেন, তাঁকে একাধিকবার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই হুমকিদাতাদের লক্ষ্য। বিশ্বদ্যিালয়ের অন্য শিক্ষকদের বিষয়ে তিনি বলেন, যাঁরা হুমকি পাচ্ছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বেশ আতঙ্কে রয়েছেন। রাজধানীর কয়েকটি থানায় করা সাধারণ ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমন হুমকি পেয়ে গত ২৭ জুন ধানমন্ডি থানায় গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক কামাল পাশা চৌধুরী একটি জিডি করেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, গত ২৪ জুন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩ তিনিসহ ২৫ জনকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। কামাল পাশা চৌধুরী ২০১৩ সালে পাওয়া আরেকটি হুমকির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আমাকেসহ ১৬ জন ব্লগারকে ফেসবুকের মাধ্যমে হত্যার হুমকি দেয় জঙ্গিরা। এখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি। আমি ডায়েরি করার পর পুলিশ যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি।’ সাধারণ ডায়েরির তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কথা বলা হয়েছে। তবে কে বা কারা হুমকি দিয়েছে, তা বের করতে পারিনি।’ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে (১০ জুন ও ৯ সেপ্টেম্বর) দুবার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন একজন অভিনেত্রী। তিনি রমনা ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় পৃথক ডায়েরিও করেছেন। তাতে বলা হয়, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের জঙ্গি সংগঠন আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। এরপর থেকে আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’ গত তিন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষককে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এর মধ্যে সর্বশেষ হুমকি পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাকিদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঢাবির সাবেক উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক আবুল বারকাত, নিহত বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় এবং নিহত ফয়সল আরেফিনের (দীপন) বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। এসব হুমকির ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ, ধানমন্ডি ও গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো হুমকিদাতাকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। জানতে চাইলে অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘আমার ছেলে মারা গেছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। সেই দিন রাতে আমার মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয় জঙ্গিরা। পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি।’ ১০ নভেম্বর মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর তাঁর নিরাপত্তার জন্য বাসায় ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। এই নিরাপত্তাব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিষয়টিকে স্বস্তিকর নয় বলেও মনে করছেন বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ। শাহবাগ থানায় জিডি করার পর পুলিশি নিরাপত্তা পাননি বলে জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। গত ১৭ অক্টোবর আরাফ আল ইসলাম, আইএসবি নামে একটি সংগঠনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁকে এ হুমকি দেয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের বাসায় পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এটা কোনো সমাধান নয়। এই ধরনের নিরাপত্তা স্বাভাবিক চলাফেরা যে সম্ভব নয়, তা-ই তুলে ধরে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্যরা মূলে হাত দিচ্ছেন না। কোনো ঘটনা ঘটলে তারা শুধু মাঠ পর্যায়ের খুচরো লোকদের ধরছেন, তাদের গডফাদারদের কিছু বলছেন না। তাই সমস্যা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। সামগ্রিক বিষয় তাঁরা যেভাবে দেখছেন তাতে গলদ আছে। আসলে মৌলবাদের হাতি ঘরের ভেতরে রেখে বাইরে সুঁই খুঁজলে চলবে না।-প্রথম আলো ১৪ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে