রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৫৫:২২

মুম্বাই স্টাইলে প্যারিসে হামলা

মুম্বাই স্টাইলে প্যারিসে হামলা

নিউজ ডেস্ক: বিশ্বসংস্কৃতি ও ফ্যাশনের ‘রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সের প্যারিসে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা হলো। রক্তে ভিজল সৌন্দর্যের নগরী। স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় নগরী প্রকম্পিত হলো সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ বোমা ও গুলির শব্দে। সন্ত্রাসীরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে পাখির মতো মানুষ মারল। সর্বশেষ খবর মতে, সেখানে অন্তত ১২৮ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক মানুষ। ভারতের মুম্বাইয়ে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর একই কায়দায় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুম্বাইয়ের ঘটনার সঙ্গে প্যারিসের ঘটনার মিল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা মার্কিন গণমাধ্যমকেও এ কথা জানিয়েছেন। ঘটনার পরপরই জঙ্গি সংগঠন আইএস এর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। প্যারিসে ছয়টি স্থানে একই সময়ে ধারাবাহিক ওই হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে শহরের কেন্দ্রস্থল বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে। সেখানে অন্তত ১২০ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। হামলা হয়েছে ফ্রান্সের বিখ্যাত স্টেডিয়াম স্তাদে দ্য ফ্রান্সের বাইরেও। যেখানে সে সময় চলছিল বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্সের ফুটবল ম্যাচ। ম্যাচটি দেখতে মাঠে হাজির ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ, সঙ্গী জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমেয়ার। এ ছাড়া একই সময়ে প্যারিসের চারটি রেস্তোরাঁ ও বারের সামনে বোমা বিস্ফোরণ ও গুলিবর্ষণ হয়, তাতে অন্তত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে রয়টার্স। আরও কয়েকটি স্থানে গুলিবর্ষণের খবর এলেও তার বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। এ ঘটনাটি এমন সময় ঘটল যখন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে তাদের বিমান হামলায় জঙ্গি সংগঠন আইএসের জল্লাদ হিসেবে খ্যাত ‘জিহাদি জন’ নিহত হয়েছেন। প্যারিস হামলার পরপরই আইএস এর দায় স্বীকার করে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছে। এ ঘটনার পর ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেছেন, এ হামলা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইসলামিক স্টেটের যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এ হামলার পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি বাইরে থেকে করা হলেও ফ্রান্সের ভিতর থেকেও সন্ত্রাসীরা সহায়তা পেয়েছে। হামলার পর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট। একই সঙ্গে দেশটির সব সীমান্ত বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। আর নাগরিকদের ঘরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের পাশাপাশি ১ হাজার ৫০০ সেনাও মোতায়েন করা হয়েছে প্যারিসে। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আজ থেকে তুরস্কে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে যোগদানও বাতিল করেছেন ওলাঁদ। তিনি জানান, আট সন্ত্রাসীও নিহত হয়েছেন। এদিকে পুলিশ আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে সব ধরনের সমাবেশ ও জমায়েত এবং তিনজনের বেশি মানুষের একত্র হয়ে আড্ডা নিষিদ্ধ করেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বনেতারা নিন্দা জানিয়েছেন। ফরাসি জনগণের পাশেও থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। ঘটনার সময় বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে কনসার্ট দেখতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। এরই মধ্যে অন্তত তিন হামলাকারী হলে ঢুকে একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। পরে হামলাকারীরা ওই হলে অনেককে জিম্মি করলে পুলিশ ভারী অস্ত্রসহ সেখানে অভিযান চালায়। এতে তিন হামলাকারী বোমা দিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেন। পুলিশ জানিয়েছে, সেখান থেকে ১২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার পর রাজধানীতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। গতকাল কোনো সাধারণ মানুষই ঘরের বাইরে বের হননি। প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন : বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে হামলার এক প্রত্যক্ষদর্শী জুলিয়েন পেরেজ। তিনি একজন রেডিও সাংবাদিক। তার উদ্ধৃতি দিয়ে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, “তারা অন্ধের মতো গুলি চালাচ্ছিল। যে যেদিকে পারে দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছিল। আমি বহু মানুষকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখেছি। ওদের আমি গুলি চালাতে চালাতে জিহাদি স্লোগান দিতে দেখেছি। শুনেছি, ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ইংরেজিতে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে বলছে, ‘তোমরা আমাদের সিরিয়ায় যেভাবে হামলা চালাচ্ছ, তার জন্য তোমাদের তো এ মূল্য দিতেই হবে!’ নিজেদের মধ্যে ওদের এ কথাও বলতে শুনেছি, ‘আজ সব কটাকেই শেষ করে দেব’। ওরা এই কথাও বলছিল, ‘আমরাও তো আর বেঁচে ফিরব না এখান থেকে। সবাইকে মেরেই যাব’।” পেরেজ আরও বলেন, হামলা যখন শুরু হয় তখন তিনি ছিলেন মঞ্চের ওপরের অংশে। হলে ঢুকে পড়ে চার সন্ত্রাসী। এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। তাদের মুখোশ পরা ছিল না, তবে পোশাক ছিল কালো। হামলাকারীরা ছিল তরুণ। তারা গুলি করার সময় একটুও নড়াচড়া করেনি। হলটির পেছনে দাঁড়িয়ে তারা শুধু গুলি চালিয়েছে। বৃষ্টির মতো গুলি করেছে। আসলে এটি ছিল একটি নরকের চিত্র। পেরেজ আরও বলেন, ‘গুলি শেষ হয়ে গেলে বন্দুকধারী যুবকরা আবার গুলি ভরার সময় পালিয়ে একটি খালি কক্ষে চলে যায়। কিন্তু থিয়েটার রুম থেকে আমাদের বেরোনোর কোনো পথ ছিল না। আমরা আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। আরও কিছুক্ষণ গুলি চালানোর পর হামলাকারীরা থামে। এরপর তারা যখন আবার রাইফেলে গুলি ভর্তি করছিল, তখনই আমরা পালাই।’ পুলিশ জানায়, এ ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের পর হামলাকারীরা সেখানে শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে জিম্মি সংকটের রক্তাক্ত অবসান ঘটায়। আরেক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, হলরুমে এক জঙ্গি জিম্মিদের একের পর এক গলা কাটছিল। হামলাকারী সবাই নিহত : সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসে আটজন অস্ত্রধারী অংশ নেয়। তারা সবাই নিহত হয়েছে। যারা হামলায় সহযোগিতা দিয়েছে তাদের প্রতি কোনো দয়া দেখানো হবে না।’ প্যারিসের পাবলিক প্রসিকিউটর ফ্রাঙ্কোয়িস মোলিনসের মুখপাত্র জানিয়েছেন, নিহত আট সন্ত্রাসীর মধ্যে সাতজন বিভিন্ন স্থানে নিজেদের শরীরে বেঁধে রাখা বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের উড়িয়ে দিয়েছে। আর একজন হামলাকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আইএসের দায় স্বীকার : হামলার দায় স্বীকার করে অনলাইনে এক বিবৃতি দিয়েছে আইএস। আইএস দাবি করে, ‘বিস্ফোরক কোমরবন্ধনী পরে ও অস্ত্র হাতে নিয়ে আমাদের আট ভাই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সফল হামলা করেছে।’ হামলাকারীর মরদেহের পাশে সিরিয়ান পাসপোর্ট : প্যারিস স্টেডিয়ামের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো এক সন্ত্রাসীর মরদেহের পাশ থেকে একটি সিরিয়ান পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। বিশ্বনেতাদের নিন্দা : প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের ঘটনায় বিশ্বনেতা ও সংস্থা নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ হামলার নিন্দা জানিয়ে দোষী ব্যক্তিদের বিচারে দাঁড় করানোর আহ্বান জানিয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফ্রান্সের পাশে থাকার কথা বলেছে ন্যাটো। যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এক টুইটে বলেন, ‘ফ্রান্সের মানুষদের সাহায্য করতে যা যা করার, আমরা তা করব।’ জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেছেন, তিনি এ হামলার ঘটনায় ‘বিস্মিত, হতবাক’। রাশিয়া এ হামলার নিন্দা করে ফ্রান্সের সরকার ও জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স।-বিডি প্রতিদিন ১৫ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে