মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:১২:২৫

চার কারণে জেএসসি পাবলিক পরীক্ষা নয়

চার কারণে জেএসসি পাবলিক পরীক্ষা নয়

নিউজ ডেস্ক: চার কারণে জেএসসি ‘পাবলিক’ পরীক্ষা নয়। এই পরীক্ষার সনদ উচ্চশিক্ষার ভর্তিতে মূল্যায়নে আসে না। চাকরিজীবনে এই স্তরের সনদ চাওয়া হয় না। বিদেশে উচ্চশিক্ষায় এই সনদের চাহিদা নেই। আন্তর্জাতিকভাবে এই স্তর ডিগ্রি হিসেবে কোনো স্বীকৃত নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই চার কারণে জেএসসিকে ‘পাবলিক’ না বলে ‘জাতীয় বা শ্রেণী উত্তীর্ণে’র পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ২৯ অক্টোবর জেএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) কোনো পাবলিক পরীক্ষা নয়। এটা শ্রেণী উত্তীর্ণের পরীক্ষা। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নানা জিজ্ঞাসার তৈরি হয়। পরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে ১২ নভেম্বর তার মুখোমুখি হয় । তিনি এ সময় বলেন, ‘এসএসসি-এইচএসসি পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে স্বীকৃত। সে হিসেবেই এ দুটির সনদ দেয়া হয়ে থাকে। পাবলিক পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে উচ্চশিক্ষায় পরবর্তী ভর্তি, বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং এটা দেশে-বিদেশে চাকরির জন্য মূল্যায়িত হয়। দশম এবং দ্বাদশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুটি পরীক্ষাও আছে। জেএসসি পরীক্ষার সনদ দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি বা চাকরি কোনো ক্ষেত্রেই চাওয়া হয় না। এখানেই জেএসসি পাবলিক না শ্রেণী উত্তীর্ণের পরীক্ষা সেটি চিহ্নিত হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা এই পরীক্ষা কয়েকটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে চালু করেছি। তা হচ্ছে, স্কুলে ভর্তিকৃতদের ধরে রাখা এবং ড্রপআউট (ঝরেপড়া) কমানো। আমরা এই পরীক্ষার গুরুত্ব শুধু শ্রেণী উত্তীর্ণ আর বৃত্তি বণ্টনের মধ্যে রেখেছি। এই বিবেচনায় এই পরীক্ষার গুরুত্ব সর্বোচ্চ বোর্ড পর্যায়ে আর সর্বনিম্ন প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে। বোর্ডভিত্তিক মেধাবৃত্তি দেয়ার কারণে এর গুরুত্ব বোর্ড পর্যন্ত আসছে। নইলে এটার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠানের বাইরে যেত না।’ মন্ত্রীর এ কথার সত্যতা অবশ্য বাস্তব ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে প্রথম জেএসসি- জেডিসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ব্যাচে যারা জেএসসি-জেডিসি পাস করেছে, তারা গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। এবারও দিচ্ছে। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এই পরীক্ষার নম্বর বা জিপিএ চাওয়া হয়নি। তাছাড়া বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার কোনো বিজ্ঞপ্তিতেই এই পরীক্ষাকে ডিগ্রি হিসেবে বিবেচনা করে সনদ চাওয়া হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০১০ সালের প্রথম জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় ১৫ লাখ ৫ হাজার ৩৯১ জন অংশ নিয়েছিল। ষষ্ঠ বছরে এবার হয়েছে ২১ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭১ জন। এই থেকেই বোঝা যাচ্ছে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখের বেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। আসলে অনেকেই মনে করে থাকেন, ৫টি ক্লাস পড়েছি। আর তিনটি ক্লাস পড়লে বোর্ডের একটি সনদ পাব। এটার মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়ে হলেও চাকরি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, আগে অষ্টম শ্রেণী পাস করে কেউ ঝরে পড়লে হয়তো কর্মজীবনে চলে যেত। তখন অনেকে স্কুলে গিয়ে অষ্টম শ্রেণীর সনদ নিত। এই পরীক্ষার কারণে এখন কোনো শিক্ষার্থী ঝরে পড়লে তাকে এ ধরনের সনদের জন্য আর স্কুলে যেতে হবে না। জাতীয় পর্যায়ে যাচাই করা মানদণ্ডের আলোকে দেয়া সনদ দেখিয়েই এখন তারা এ ধরনের চাকরি নিতে পারবে। জেএসসি পরীক্ষার সার্থকতা এখানেও নিহিত। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে পাবলিক পরীক্ষা দুটি। আর পঞ্চম শ্রেণীর আগে কোনো পরীক্ষাই নেই। গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক কেএম এনামুল হক জানান, শ্রীলঙ্কাসহ সার্ক দেশগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করেছি আমরা। বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও পঞ্চম শ্রেণীতে পাবলিক বা জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা নেই। শ্রীলঙ্কায় এই স্তরে বৃত্তি পরীক্ষা নেয়া হয়। অষ্টম শ্রেণীতে পরীক্ষা বাংলাদেশের বাইরে কেবল নেপালে আছে। ১০ এবং ১২ ক্লাসের পরীক্ষা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এর বাইরে নবম শ্রেণীর আগে শ্রীলঙ্কা, চীন, রাশিয়া, জাপান, সুইডেনে পরীক্ষা নেই। ইউরোপে সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে অষ্টম শ্রেণীর আগে পরীক্ষা নেই। অবশ্য সিঙ্গাপুর ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে পরীক্ষা নেয়া শুরু হয়। যুক্তরাজ্যে দশম শ্রেণী থেকে পরীক্ষা শুরু হয়। জাপানে নবম শ্রেণীর পর দ্বাদশ শ্রেণীতে পরবর্তী পরীক্ষা। সুইজারল্যান্ডে অষ্টম শ্রেণীর পরবর্তী পরীক্ষা চতুর্দশ শ্রেণীতে। তিনি বলেন, যেসব দেশে আমরা পরীক্ষার পরিসংখ্যান পাই, সেসব দেশে ওই পরীক্ষার বাইরে আর কোনো পরীক্ষা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে চারটি পাবলিক পরীক্ষা ছাড়া স্কুল পর্যায়ে নানা টেস্টের আড়ালে অসংখ্য পরীক্ষা আছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় জর্জরিত। আমরা পরীক্ষার পরিবর্তে শিক্ষার্থীর ধারাবাহিক মূল্যায়ন চাই। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, জেএসসি পরীক্ষা আয়োজনের যেসব লক্ষ্য আছে সেগুলো হচ্ছে- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীর প্রতি যত্ন বৃদ্ধি, সব প্রতিষ্ঠানের মান সমপর্যায়ে আনা, পরবর্তী পাবলিক পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক আবদুল আউয়াল বলেন, সাধারণত ‘টার্মিনাল’ (প্রান্তিক) পরীক্ষাগুলোকেই পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এটা একটি স্তর শেষে নেয়া হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী ১০ এবং ১২ ক্লাস শেষে নেয়া পরীক্ষাকে পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাকরি ও ভর্তিতে চাওয়া হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশের এসএসসি-এইচএসসিই পাবলিক পরীক্ষা হওয়ার কথা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের উচিত হবে শিক্ষানীতি অনুযায়ী চলা। এতে প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, তখন জেএসসি থাকবে না। তিনি যথার্থই বলেছেন। তখন এই পরীক্ষার নাম হবে অষ্টম শ্রেণী সমাপনী। তবে সেটা চালু হওয়ার আগেই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাটা বাতিল করা এখন সময় আর বাস্তব দাবিতে পরিণত হয়েছে। কেননা এই পরীক্ষার কারণে স্কুলভিত্তিক লেখাপড়া উঠে গেছে। কোচিং ও গাইড বাণিজ্য বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পাবলিক না বলে যতই জাতীয় পরীক্ষা বলা হোক না কেন, বাবা-মায়েরা কিন্তু এই পরীক্ষা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে গেছেন। সেটা বন্ধে বিকল্প ভাবতে হবে। এজন্য হয় এই পরীক্ষা তুলে দিতে হবে। নইলে স্থানীয় পর্যায়ে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে।-যুগান্তর ১৭ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে