মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:৫৯:০৮

ট্রানজিট দিতে কৌশলী সরকার, সমন্বয় নেই

ট্রানজিট দিতে কৌশলী সরকার, সমন্বয় নেই

নিউজ ডেস্ক: সড়ক, নৌ ও রেলপথে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে একসঙ্গে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট হচ্ছে না। ধাপে ধাপে, আলাদা আলাদা চুক্তির মাধ্যমে এ ট্রানজিট দেওয়া হবে। আপাতত সড়কপথেই ট্রানজিট হবে। প্রায় পাঁচ বছর আগে এ চারটি দেশের মধ্যে একটি কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির মাধ্যমে একই সঙ্গে তিন ধরনের পথে ট্রানজিট দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই অবস্থান থেকে সরে এখন একটু কৌশলী পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোর কমিটির প্রধান মজিবুর রহমান বলেন, আলাদা আলাদা করে ট্রানজিট দেওয়া সঠিক হচ্ছে না। এতে জটিলতা বাড়বে। আবার আলাদা আলাদা ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা হওয়ায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে তাও এখনো নিশ্চিত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের একার পক্ষে এই বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ সড়কপথের জন্য আলাদা যান চলাচল চুক্তি করে এর মাধ্যমে ট্রানজিট দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, যা বিবিআইএন উদ্যোগ নামে পরিচিত। এর সঙ্গে ভারত ছাড়াও আছে নেপাল ও ভুটান। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে নৌপথে বিদ্যমান ট্রানজিট সুবিধা আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। নৌপথে ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্যোগও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। অবকাঠামোর বড় ধরনের সমস্যার কারণে রেলপথে ট্রানজিট নিয়ে আপাতত আলোচনা নেই। এ ছাড়া গত ৬ জুন চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সমঝোতা স্মারক করেছে। ২০১০ সালে এ দুটি বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী দেখিয়ে একটি প্রটোকলের খসড়া বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল ভারত। ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা জোরদার হলেও এ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা বড় সমস্যা। শুরুতে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়ার উদ্যোগ ছিল। আর এর পুরো বিষয়টি তদারক বা সমন্বয় করার দায়িত্বে ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখন পৃথক পৃথক চুক্তি বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ট্রানজিট দেওয়ার উদ্যোগগুলো সমন্বয় করার দায়িত্বে কোনো মন্ত্রণালয় নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোই নিজ নিজ ট্রানজিট-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করছে। যেমন বাংলাদেশের পক্ষে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় চার দেশের মধ্যে যান চলাচল চুক্তি করেছে। আবার নৌ মন্ত্রণালয় নৌ-প্রটোকল-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় দেখাশোনা করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, আলাদা আলাদাভাবে ট্রানজিটের উদ্যোগে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এখন একেক মন্ত্রণালয় একেকটি চুক্তি করে তা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু নৌ-প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ থেকে পণ্য সড়কপথে আগরতলায় গেলে তা সড়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন নৌ মন্ত্রণালয় কী করবে? তাঁর মতে, সামগ্রিকভাবে একটি ট্রানজিট-ব্যবস্থা হলে তা বাস্তবায়ন করা সহজ ও মসৃণ হতো। অবকাঠামো নিয়েও আছে বড় ধরনের সমস্যা। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ট্রানজিট অবকাঠামো ও ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। নতুন করে সড়ক নির্মাণ, স্থলবন্দর উন্নয়ন করা হয়নি। এ খাতে বিনিয়োগও খুব একটা হয়নি। অথচ ট্রানজিট সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত কোর কমিটির প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দিতে অবকাঠামো তৈরি করতে ১০ বছরে ৪৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কোর কমিটির প্রধান মজিবুর রহমান বলেন, ট্রানজিটের সঙ্গে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি জড়িত। তাই এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন না করে ট্রানজিট দিলে তা সামলানো মুশকিল হবে। মজিবুর রহমান উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোনো বিষয়ে বিরোধ হলে আলাদা আলাদা মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে। ট্রানজিটের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে এত বিশেষজ্ঞ নেই, যাঁরা এই বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারবেন। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, এ ধরনের ট্রানজিট একটি সমন্বিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে হওয়া উচিত। সড়ক, রেল, নৌ, শুল্ক, মাশুল, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৮-১০টি প্রটোকল করলেই হতো। ২০১১ সালে দেশে প্রথম ভারত, নেপাল ও ভুটানকে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়ার আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত একটি কোর কমিটি পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিটের সম্ভাবনা যাচাই-বাছাই করে পথ, মাশুল, বিনিয়োগসহ একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সেটাই ছিল সরকারি পর্যায়ে প্রথম ট্রানজিট-সংক্রান্ত প্রতিবেদন। কিন্তু তা অনুমোদন বা পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আবার ২০১১ সালের ২০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে পর্যালোচনার জন্য ট্যারিফ কমিশনের করা ট্রানজিট-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে তা পাঠানোও হয়। কিন্তু ওই প্রতিবেদনের কথা এখন আর কেউ বলেন না। অবকাঠামো দুর্বলতা: সংশ্লিষ্টরা বলছেন ট্রানজিট দেওয়ার জন্য স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নই সবচেয়ে জরুরি। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ট্রানজিটে যশোরের বেনাপোল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, লালমনিরহাটের বুড়িমারী ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হবে। এর মধ্যে বেনাপোলের অবকাঠামো মোটামুটি ভালো। অন্য তিনটি বেহাল। বেনাপোল ছাড়া অন্য কোনো বন্দরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কোনো শাখা নেই। সংশ্লিষ্ট জেলা শহর থেকে এসব স্থলবন্দরে যাওয়ার সড়কগুলোর অবস্থা বেশ নাজুক। গত বছর আখাউড়া স্থলবন্দরটি স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) বা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিচালিত করার উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে কার্যক্রম আগের মতোই চলছে। এসওপি ব্যবস্থা অনেকটা গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের মতো। পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি ও খুব দ্রুত সীমান্ত অতিক্রম করতে অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু ওজনযন্ত্র, পর্যাপ্ত লোকবলসহ পর্যাপ্ত অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার সড়কটি ভাঙাচোরা, যান চলাচলের অনুপযোগী। তামাবিল স্থলবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার মতো অবকাঠামো নেই। টেবিল-চেয়ার নিয়ে চালাঘরে শুল্কায়নের কাজ চলে। পঞ্চগড় শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের বাংলাবান্ধায় প্রতিদিন গিয়ে শুল্কায়ন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। আর বুড়িমারী স্থলবন্দরে যেতে সড়কটির বেহাল দশা। বন্দরটির অবকাঠামোও দুর্বল। কত টাকা লাগবে: ট্যারিফ কমিশনের কোর কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রানজিট-সংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়নে ১০ বছরে ৪৭ হাজার ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে রেলপথে সবচেয়ে বেশি ২৯ হাজার ২২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ দরকার হবে। সড়কপথ উন্নয়নে ১১ হাজার ৯৪১ কোটি ২৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ দরকার। আর স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়নে লাগবে ২০১ কোটি টাকা। এ ছাড়া, ড্রেজিং ও নৈশকালীন চলাচলের জন্য নৌপথেও বিনিয়োগ করতে হবে। এতে প্রয়োজন হবে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ট্রানজিট-সুবিধার আওতায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারকেও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, তাই এ বন্দর দুটি সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নে ৪ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য ওঠানামার সক্ষমতা বাড়াতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে মংলা বন্দরের ড্রেজিংসহ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজন ২ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। বিনিয়োগ কীভাবে হবে—এ প্রশ্ন করা হলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ অংশের অবকাঠামো বাংলাদেশকেই তৈরি করতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের পক্ষে এসব অবকাঠামো তৈরি করা কঠিন হবে। তাই ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে এসব অবকাঠামো তৈরি করা উচিত।-প্রথম আলো ১৭ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে