মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০১:৫০:১৮

মওলানা, আমাদের ক্ষমা কর না

মওলানা, আমাদের ক্ষমা কর না

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : আজ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।১৯৭৬ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে চলে যান আধিপত্যবাদ, স্বৈরতন্ত্র আর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আজীবন বিদ্রোহী এই মহান ব্যক্তিত্ব।বছর শেষে এই দিবসে আমরা সবাই তাকে স্মরণ করি, তাঁকে নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলি।আজকেও হয়তো এর ব্যক্তিক্রম হবে না। এ উপলেক্ষে আমাদের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সনসহ আরো অনেকে মওলানার গুণকীর্তন করে বাণী দিয়েছেন।এছাড়া নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।অনেকেই মাজারে পুস্পস্তবক অর্পন ও ফাতেহা পাঠ করছেন।মাজার প্রাঙ্গনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভাসানী’র ভক্ত-অনুসারীরা ভিড় করবেন।এসবের কী উদ্দেশ্য, তা হয়তো সাধারণ জনগণের বুঝতে অসুবিধে হয় না।ফলে এ সব মতলব একটু খােলাসা আর মওলানার বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা চাইতেই আমার আজকের লেখা। আমরা সবাই কমবেশী অবগত, মওলানা ভাসানীর স্বপ্ন, ভালবাসা, দেশপ্রেম, জাতির জন্য তাঁর ত্যাগ।ফলে যারা জীবিত ভাসানীকে মূল্যায়ন করেনি, শান্তি দেয়নি বরং বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছি, এমন কি যারা এখনো তাঁর মৃত আত্মা আর নীতি আদর্শের সাথে প্রতারণা করছেন তাদের মুখে মওলানার প্রশংসা তথা গুণকীর্তন শুনলে আমাদের কষ্ট হয়, লজ্জাবোধ হয়। কেননা, মওলানা ভাসানী তো সেই মহান বাঙালী, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আপোষহীন, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, উপনিবেশবাদ বিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামী পুরুষ, জাতীয় ও স্থানীয় সব সংকটেই জনগণের পাশে থেকেছেন, যিনি ছিলেন আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মজলুম জননেতা।যার স্বপ্ন ছিলো একটি শোষণহীন গনতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। সেই ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে তার সংগ্রামী জীবন শুরু।এরপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা সংগ্রামসহ উপমহাদেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মজলুম জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শোষকের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল নির্ভীক ও বলিষ্ঠ।ভারতের সম্প্রসারণবাদী কর্মকাণ্ড ও পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন এবং মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে, ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মূলত তার এ আন্দোলনেই ভারতকে প্রথমবারের মতো ফারাক্কা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। প্রসঙ্গত, ১৯৪৯-এর ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন করে এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। পরে নীতি ও আদর্শগত কারণে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে একই বছর ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করে এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন ভাসানী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ দলের নেতৃত্বেই ছিলেন। মওলানার এই দীর্ঘ সংগ্রামে জীবনে জেল-জুলুম ভোগ থেকে শুরু করে নানা গঞ্জনার স্বীকার হয়েছেন।এসব কিছুর পেছনে তাঁর একটাই স্বপ্ন ছিল শোষণ ও বঞ্চনাহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। কিন্তু আজ ভাসানীর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে যারা তাঁর প্রশংসা করছেন, তাঁকে শোষণ ও বঞ্চনাহীন এবং প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের প্রেরণার প্রতীক বলছেন।তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমরা মুখে যা বলছো তা কি তোমাদের অন্তরে আছে। তোমরা কি মওলানার সেই আদর্শে বিশ্বাস কর? তোমরা কি মওলানার স্বপ্নের সেই শোষণ-নিপীড়নহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছো, না গণতন্ত্রকে হত্যা করে সেখানে জুলুম-নিপীড়নের রাজত্ব কায়েম করেছো? এ যেন মুখে মধু অন্তরে বিষ। এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কী হতে পারে! যদিও জানি এসবের প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে নেই। কিন্তু জনগণ ঠিকই এর জবাব জানে।আমাদের প্রশ্ন হলো- তোমরা যদি মওলানা ভাসানীর নীতি আদর্শে বিশ্বাস না কর, তোমাদের কাছে ক্ষমতাই যদি হয় সবচেয়ে মোক্ষম বিষয়, তবে কেনইবা তোমরা আজ মওলানাকে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণার উৎস বলছো? এটা কী মওলানার মৃত আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়? এভাবে আর কত প্রতারণা? তাই সবশেষে মওলানা ভাসানীর মৃত আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বলবো, মওলানা তুমি আমাদের ক্ষমা কর না। আমরা নিমুক হারাম, আমরা তোমার নীতি আদর্শের বিশ্বাসঘাতক, আমরা প্রতারক। আমরা তোমার সেই শোষণ-নীপীড়নহীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এই বাংলার জমিনে স্বৈরাচারের সাথে হাত মিলিয়ে গড়েছি এক অভিনব শাসনব্যবস্থা।যেখানে জুলুম নিপীড়নে আজ বাংলার জনপদে আহাজারি করছে হাজারো বনী আদম। এরপরও আমাদের বিশ্বাস, তোমার দেখানো সেই পথ ধরেই হয়তো একদিন এই বাংলার জমিনে শোষণ নিপীড়নের অবসান হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণ-নিপীড়নহীন এক গণতান্ত্রিক সমাজ। সেদিনের অপেক্ষায় বাংলার মুক্তিকামী জনগণ। লেখক: গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected] (লেখকের একান্তই নিজস্ব মতামত, এমটিনিউজ২৪ডটকমের সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয়) ১৭ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে