সোমবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৮, ১২:২৩:১৬

টার্নিং পয়েন্ট খালেদা জিয়ার মামলা

টার্নিং পয়েন্ট খালেদা জিয়ার মামলা

কাফি কামাল : কথা সত্য। ঢাকায় বারুদের গন্ধ নেই। রাজনীতিও শান্ত। তবে ভেতরে ভেতরে তীব্র চাপানউতোর। বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি মামলাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এই পরিস্থিতি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি আগামী দিনের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হতে চলেছে।

এ মামলা ঘিরে সরকার ও বিরোধী শিবিরে জোর প্রস্তুতি চলছে। বিএনপিতে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। শনিবার রাতেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ নিয়ে দীর্ঘসময় কথা বলেছেন নিজের আইনজীবীদের সঙ্গে। দলের নেতারাও এ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছেন। রায় কী হবে এবং রায়ের পর পরিস্থিতি কোন্‌দিকে গড়াবে সেটাই বিএনপি নেতাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি এখন একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে। যেকোনো দিন এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবে। তবে রায় কবে হবে তা হলফ করে বলা কঠিন। মামলার রায় পরবর্তী পরিস্থিতির ব্যাপারে গভীর নজর রাখছে সরকারপক্ষও। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দল ও প্রশাসনকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক টিমের সফরের সময়ও তৃণমূল পর্যায়কে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া হবে। অতীতে বিরোধী দলের আন্দোলন প্রশাসন কঠোর হস্তে দমন করেছে।

এক্ষেত্রে সংগঠনকে তেমন কোনো প্রয়োজন হয়নি সরকারের। আগামীতেও প্রশাসন দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা চলবে। তবে রায় বিরুদ্ধে গেলেও খালেদা জিয়ার সামনে আপিলের সুযোগ থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগে যেতে পারবেন তিনি। বাংলাদেশে সাধারণত দুর্নীতির মামলায় নিম্ন আদালতে কারো সাজা হলেও তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হন না। নির্বাচনে যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয় আসে চূড়ান্ত রায়ের পর। কিন্তু এক্ষেত্রে আইন সংশোধনের মাধ্যমে নিম্ন আদালতে সাজার পরই নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান করার চিন্তা সরকারের একটি অংশের মধ্যে রয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
 
এই যখন অবস্থা তখন ট্রাস্ট মামলায় বিচারের গতি-প্রকৃতি ও নতুন করে ১৪টি মামলা বিশেষ আদালতে স্থানান্তর নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিএনপি নেতারা বলছেন, মামলার রায় ও আগামী দিনে দলের নেতৃত্ব নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নয়। খালেদা জিয়াকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি নিয়েই তাদের সব উদ্বেগ। দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা অভিযোগ করে বলছেন, বছরের পর বছর ধরে মামলার জট তৈরি হয়েছে নিম্ন আদালতে।

সেদিকে সরকারের তেমন নজর না থাকলেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের মামলাগুলোয়। বিশেষ আদালতের মাধ্যমে ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে প্রতি সপ্তাহের একাধিক দিন। তার প্রতিটি হাজিরার দিন নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের। দায়ের করা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। সম্প্রতি নতুন করে খালেদা জিয়ার ১৪টি মামলা স্থানান্তর করা হয়েছে বিশেষ আদালতে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা ও সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা মামলার রায় নিয়ে আগাম বক্তব্য দিচ্ছেন। বিষয়গুলো স্বাভাবিক হিসেবে নিতে পারছেন না বিএনপির নেতাকর্মীরা।

পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা গুঞ্জন। সবখানে এখন একই প্রশ্ন- ট্রাস্ট মামলার রায় খালেদা জিয়ার বিপক্ষে গেলে কি করবে বিএনপি? আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিইবা হবে তাদের কৌশল? নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক ব্যাটনই থাকবে কার হাতে? এমন পরিস্থিতিতে শনিবার রাতে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া। সে বৈঠকে ডাক পেয়েছিলেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় অন্য দুই আসামি কাজী সলিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিনের আইনজীবী আহসান উল্লাহ।

১৮ই জানুয়ারি আদালতে যুক্তিতর্ক করতে গিয়ে খালেদা জিয়ার মনোযোগ কেড়েছেন তিনি। অন্যদিকে ট্রাস্ট মামলার রায় নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বিএনপি। শুক্রবার কক্সবাজারের চকরিয়ায় ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির নেতা ও এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গার দেয়া একটি বক্তব্যের (১৫ দিনের মধ্যে খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে) সমালোচনা করে গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি টুইট করেছেন খালেদা জিয়া। মামলার রায় নিয়ে রাঙ্গার এ বক্তব্যকে ‘আদালত অবমাননা’ আখ্যায়িত করে টুইট করেছেন।

তিনি লিখেছেন, “শুক্রবার, জানুয়ারি ১৯, পত্রিকায় এসেছে, বিনাভোটের এক প্রতিমন্ত্রী বলেছে, ‘১৫ দিনের মধ্যে খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে।’ বিচারাধীন মামলার রায় ঘোষণা আদালত অবমাননা নয় কি? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন, জনগণ সেইদিকে সতর্ক নজর রাখছে।”

বিএনপি নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা বলছেন, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। দুইবার বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন সংসদে। ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনের লড়াইয়ে হারের নজির নেই তার জীবনে। দেশের শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলের একটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিরোধী জোটের শীর্ষ নেত্রী। সবসময় আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন তিনি। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার মানসিকতা যে তার নেই এটাও প্রমাণ করেছেন বারবার। সর্বোপরি খালেদা জিয়া একজন ৭৩ বছর বয়স্ক নারী। তারপরও কোন সৌজন্য আচরণ পাচ্ছেন না তিনি।

বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের অভিযোগ, আদালত প্রাঙ্গণে মানসম্মত দূরে থাক, মহিলাদের জন্য সাধারণ মানের কোনো ‘ওয়াশ রুমের’ ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ৭৩ বছর বয়স্ক দেশের একজন বিশিষ্ট নারী খালেদা জিয়াকে সপ্তাহে তিনদিন (১৬, ১৭ ও ১৮ই জানুয়ারি) একটি অস্থায়ী আদালতে পূর্ণ কার্যদিবস হাজির থাকতে হচ্ছে। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনও আদালতে কেটেছে খালেদা জিয়ার। পুত্র কোকোর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনও তাকে থাকতে হবে আদালতে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে রায় কি হবে তারা জানে। বিচারাধীন একটি বিষয়ে এমন মন্তব্যকে আমি আদালত অবমাননা বলে মনে করি। বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার ধরন ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার যে প্রতিশোধের রাজনীতি তা বাস্তবায়নের একটি প্রক্রিয়া চলছে।

রাজনৈতিক মহলের মতে, আগামী মাসেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। একই মামলার দ্বিতীয় আসামি বিএনপির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান। একই আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতির আরেকটি মামলার বিচারকাজও দ্রুত এগোচ্ছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের ওপর নির্ভর করবে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচনের ধরন। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৌশল নির্ধারণ করছে বিএনপিও। আগামী নির্বাচন ঘিরে দিল্লির সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়া। -এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে