সোমবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৮, ০১:৩৪:৫৬

প্রমত্তা সেই তিস্তা এখন সরু খাল

প্রমত্তা সেই তিস্তা এখন সরু খাল

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর থেকে : প্রমত্তা তিস্তার ভরা যৌবন আর নেই। বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে উঠলেও তিস্তা এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে নদীর দেড় শ কিলোমিটার এলাকা মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। যৌবনহারা তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। যতদূর চোখ যায়, শুধু ধু-ধু বালুচর। তিস্তার বুক চিরে এখন নৌকার পরিবর্তে নানা ধরনের যানবাহন চলাচল করছে।

চরে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। শুকনো বালুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে সদ্য নির্মিত দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু, যা এখনো উদ্বোধনই করা হয়নি। তিস্তার এ মরণদশার ফলে সংযুক্ত ঘাঘট নদ, বুড়ি তিস্তা, আলই কুমারী, বুড়াইল, খোকসা ঘাঘট, আখিরা নদীর অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে রংপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে বুল্লাই, টেপা, ধুম ও ইছামতী নদী।

তিস্তার এই মরণদশার কারণ সম্পর্কে পানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা ব্যারাজের উজানে ভারত তাদের গজলডোবা এলাকায় বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তিস্তায় পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এ ছাড়া নিয়মিত ড্রেজিং না করার কারণে তিস্তায় পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। ফলে শুষ্ক মৌসুমের অনেক আগেই তিস্তা পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।

পানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবিলম্বে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা না হলে তিস্তা পুরোপুরি মরে যাবে। হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। ভয়াবহ মরু প্রক্রিয়ার কবলে পড়বে রংপুর অঞ্চল। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানিবিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তাকে উত্তরের জীবনরেখা বলা হয়। বছরজুড়ে তিস্তায় অথৈ পানি থাকত। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজের উজানে ভারত গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার গতিকে থামিয়ে দেয়। এ নদীর মূল স্রোতধারাকে ব্যারাজের বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে তারা তাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে নিয়ে যায়।

২০১৩ সালে ভারত আরও একটি ক্যানেলের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এরপর গজলডোবা ব্যারাজ থেকে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি ভাটিতে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়, তা প্রায় ৭০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তিস্তা ব্যারাজে এসে যখন  পৌঁছায়, তখন নদীর স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু ফিতার আকার ধারণ করে। তিস্তা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ এই পানিই আবার ব্যারাজের গেট বন্ধ করে ঘুরিয়ে দেয় তাদের মূল সেচ খালের জল সংরক্ষণস্থলে। তারপর ব্যারাজের গেট খুলে মাঝেমধ্যে যে পানি দেওয়া হয় তা দিয়ে নদীর বুক ভেজে না।

এ অবস্থা অব্যাহত থাকায় প্রমত্তা তিস্তা এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। ৮৫০ মিটার প্রশস্ত তিস্তায় এখন ৪০ মিটার সরু খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই ৪০ মিটারের মধ্যে কোথাও হাঁটুসমান আবার কোথাও কোমরপানি। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে চার হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন। গত বছর জানুয়ারি মাসে তিস্তায় পানিপ্রবাহ ছিল ১ হাজার ৫০০ কিউসেক। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৯০০ কিউসেকে।

তিস্তা নদী দিয়ে মাত্র আধঘণ্টায় রংপুর-লালমনিরহাট যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। এতে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটত। দুর্ঘটনা ও দুর্ভোগ লাঘব করতে তিস্তা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় ৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ৯ মিটার প্রস্থ দ্বিতীয় তিস্তা সড়কসেতু। সেতুটির এক প্রান্তে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা ও অন্য প্রান্তে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা। নির্মাণকাজ শেষে সেতুটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে সেতুটি এখন ধু-ধু বালুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

গতকাল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নৌকায় করে সরু খাল পেরোতে সময় লাগে মাত্র তিন-চার মিনিট। খাল পেরিয়ে তিস্তার বুক চিরে চলাচল করছে কার, মাইক্রোবাস, টেম্পো, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল। চরে গড়ে উঠেছে অটোরিকশা ও টেম্পোর স্ট্যান্ড। লালমনিরহাটের মানুষ এসব যানবাহনে করে এসে নৌকায় খাল পেরিয়ে রংপুর শহরে যাতায়াত করে। রংপুরের মানুষও একইভাবে লালমনিরহাটে যায়-আসে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়েন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা এলাকার শারমীন সুলতানা পপি।

তিনি বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে কথা হয় তিস্তার চরে। তিনি বলেন, ‘হাতীবান্ধা থেকে লালমনিরহাট হয়ে রংপুরে যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। তিস্তা নদী পেরিয়ে যেতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। সময় সাশ্রয়ের জন্য আমরা তিস্তা নদী হয়ে যাতায়াত করি। সেতুটি চালু হলে সময় আরও কম লাগবে। এ বছরই তিস্তার বুকে যানবাহন চলতে দেখলাম। হাতীবান্ধা থেকে অটোরিকশায় করে এসে তিস্তা পার হচ্ছি।’

এদিকে তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ায় জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর। এসব চরে বোরো, ভুট্টা, আলু, মিষ্টিকুমড়া, মরিচ, বেগুন, তামাকসহ নানা ধরনের ফসলের আবাদ করছেন কৃষকরা। গঙ্গাচড়ার মহীপুরের কৃষক আক্কাছ আলী বলেন, ‘দুই বিঘা জমি তিস্তা ভাঙি গেইচে। এলা চরোত চার বিঘার মতো জমিত তামাক, মিষ্টিকুমড়া আবাদ কচ্চি। ফলনও ভালো হইচে।’ তিস্তায় মাছ ধরে সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করত পাড়ের মানুষ।

পানি না থাকায় তারা বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। তাদেরই একজন হামিদুল হক। তিনি এখন অটোরিকশা চালান। তিস্তার চরে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমার বাপ-দাদা তিস্তায় মাছ মারি সংসার চালাইচে। আমারও ওই পেশা আচিল। নদীত পানি না থাকায় মাছও নাই। এক বছর ধরি ওই পেশা ছাড়ি দিচি।’

গঙ্গাচড়া উপজেলার মহীপুর গ্রামের ৯০ বছর বয়সী আয়নাল হক বলেন, ‘তিস্তায় আচিলো হামারগুল্যার আয়-রোজগারের একমাত্র পথ। নৌকাত চড়ি মাছ মারি বেচেয়া সংসার চালাচি। এলা তিস্তার পানিয়ে নাই। হাঁটিয়া তিস্তা পার হওয়া যায়। চেংরারা তিস্তার চরোত ফুটবল খেলায়।’

রিভারাইন পিপলের পরিচালক নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা মরতে বসেছে। অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা না হলে নদীটি হারিয়ে যাবে। তিস্তাকে বাঁচাতে ভারত যদি তিস্তা চুক্তি না করে, তাহলে ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে পানি পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ মরু প্রক্রিয়ার কবলে পড়বে রংপুর অঞ্চল। হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য।’

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানিবিজ্ঞান শাখার (হাইড্রোলজি বিভাগ) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশীদ বলেন, তিস্তা নদীতে প্রতি বছর পলি-বালু জমে। তিস্তাকে ব্যবহার-উপযোগী রাখতে হলে প্রতি বছর পলি-বালু ড্রেজিং করা দরকার। কিন্তু গত ৪০ বছরেও তিস্তায় ড্রেজিং করা হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়ার পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, উজান থেকে যে পরিমাণ পানি আসে তা তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচের জন্য বিভিন্ন ক্যানেলে সংরক্ষণ করা হয়। এতে তিস্তা নদীতে পানিপ্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি। ব্যারাজের ভাটিতে পানির প্রবাহ একেবারেই কমে যাওয়ায় নদীর দেড় শ কিলোমিটার এলাকা এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। -বিডি প্রতিদিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে