বৃহস্পতিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ১২:৫৫:৪৮

আদালতে তুমুল হট্টগোল, বাইরে শোডাউন

আদালতে তুমুল হট্টগোল, বাইরে শোডাউন

নিউজ ডেস্ক : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে তুমুল হট্টগোল হয়েছে গতকাল। হট্টগোল চলাকালে কিছু সময়ের জন্য বিচারক এজলাস ছেড়ে চলে যান। কয়েক মিনিটের বিরতির পর ফের আদালতের কার্যক্রম চলে।

শুনানির শুরুতেই মামলার প্রধান আসামি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে গতকাল বকশীবাজারে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতে এ ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে আগের দিনের সংঘর্ষের কারণে গতকাল আদালতের বাইরে কড়াকড়ি আরোপ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

যদিও হাজিরা শেষে খালেদা জিয়ার আদালত ত্যাগের সময় হাইকোর্ট এলাকায় শোডাউন করেন বিএনপি কর্মীরা। মঙ্গলবার হাইকোর্টের সামনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনার জেরে গতকাল ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। হাইকোর্টে প্রবেশে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। সেখান থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয় ৪২ জনকে।

যার মধ্যে ছিলেন ২ জন নারী। আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে ট্রাস্টের জমি কেনা সংক্রান্ত কাগজে খালেদা জিয়ার নাম প্রসঙ্গে আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি (দুদকের আইনজীবী) বলেছেন কেন প্রধানমন্ত্রী লিখলেন না। কেন সেখানে খালেদা জিয়া লিখলেন।’

এসময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিলেট সফরের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘এই যে গতকাল প্রধানমন্ত্রী সিলেটে গেলেন। আলীয়া মাদরাসা মাঠে বক্তব্য দিলেন। এটা কি প্রধানমন্ত্রীর কাজ। নাকি ব্যক্তিগত।’ সঙ্গে সঙ্গে এই উদাহরণের প্রতিবাদ করে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘তিনি তো (আসামিপক্ষের আইনজীবী) আইনস্টাইন হয়ে গেছেন। আপনাদের এভাবে বলতে দেয়া হবে না।’

আদালতে থাকা বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা চিৎকার করলে কাজল বলেন, ‘চিৎকার করে লাভ হবে না। নো নো নো। এভাবে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বলতে পারবেন না। উনি কি মনে করেছেন নিজেকে। ফাজলামো পাইছে।’ এসময় আসামিপক্ষের আইনজীবীর মাইক বন্ধ করে দেয়া হলে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মাইক বন্ধ কেন। এখানে কি কন্ট্রোলার আছে?’

কাজল বলেন, ‘হ্যাঁ কন্ট্রোলার আছে।’ বিচারক তখন বলেন, ‘রেকর্ড দিয়ে আরগুমেন্ট করেন।’ তখনও উভয়পক্ষের মধ্যে হট্টগোল চলতে থাকে। বাধ্য হয়ে ১১টা ৫৪ মিনিটে এজলাস ত্যাগ করেন বিচারক আখতারুজ্জামান। খাস কামরা থেকে ১২টা ৮ মিনিটে আবার এজলাসে এলে বিচারকার্য শুরু হয়।

এসময় ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের এই বিচারক বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) সামনে কীভাবে এরকম হট্টগোল করেন? ম্যাডামের সম্মানের দিকে আপনারা কি লক্ষ্য করছেন না? তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বিতর্ক হতেই পারে। তাই বলে জুনিয়র আইনজীবীরা কেন হট্টগোল করবেন? আপনারা সিনিয়রদের দিকে লক্ষ্য করেন, তারা কীভাবে চুপ করে ছিলেন। তিনি আদালতে বিচারিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে বলেন।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল। মামলায় আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে বেলা সাড়ে ১১টায় আদালতে পৌঁছান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এসময় উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকার আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নুল আবেদীন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ বিএনপিপন্থি আইনজীবীবৃন্দ।

আদালতে খালেদা জিয়া উপস্থিত হলে বিষয়টি অবগত করে তার বসার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। এসময় একটি চেয়ারে বসতে দেয়া হয় তাকে। সামনে ছিল একটি টেবিল। এতে একটি টিস্যু বক্স রাখা ছিল। টেবিলে নিজের ভ্যানেটি ব্যাগ ও চশমা রেখে সেখানেই বসেছিলেন প্রায় দীর্ঘ তিন ঘণ্টা।

বেলা ৩টার দিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ক্লান্তি অনুভব করছেন জানিয়ে আজকের মতো এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে অনুরোধ করেন। ৩টা ২০ মিনিটে আদালত মুলতবি ঘোষণা করেন। তার আগের দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। গতকাল আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে প্রথমে খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর এপিএস আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্নার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আমিনুল ইসলাম।

যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম জানান, নানাভাবে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। আদালতে ঢুকতে গেলে হয়রানি করা হয়। বারবার নাম-পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘প্রবীণ আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকারের আদালতে আসার কথা ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফ্যামেলি থেকে জানানো হয়েছে, রাতে দুই বার পুলিশ তার বাসায় গিয়েছে। তাকে না পেয়ে সকাল আটটায় থাকতে বলেছে। কিন্তু আমরা তাকে আর ট্রেস করতে পারিনি।’ এভাবেই প্রত্যেককে হয়রানির মধ্যে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেন এই আইনজীবী।

কড়া নিরাপত্তা: এদিকে খালেদা জিয়ার বিশেষ আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। সকাল থেকেই সেখানে রমনা জোন ও শাহবাগ থানার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা অবস্থান করেন। মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত পুলিশ। আনা হয় পুলিশের সাঁজোয়া যান, জলকামান ও প্রিজনভ্যান। পুলিশের ধরপাকড়ের শিকার হন ৪২ জন। যাদের মধ্যে ২ নারী রয়েছেন। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার হাইকোর্ট সংলগ্ন মাজার গেটের সামনে পুলিশের প্রিজনভ্যান ভেঙে তিন নেতাকে ছিনিয়ে নেয় বিএনপি কর্মীরা।

এ সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। তাই অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে গতকাল সকাল থেকেই হাইকোর্টের সামনে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। হাইকোর্টের ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। খুব বেশি প্রয়োজন এবং পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই হাইকোর্টের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়েছে কোর্টে আসা লোকজনকে। তবে অনেকেই জরুরি কাজ থাকা সত্ত্বেও প্রবেশ করতে পারেননি। এদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই মামলা সংক্রান্ত কারণে কোর্টে এসেছিলেন। এরমধ্যে অনেকের হাজিরা ছিল ওইদিন। এমনকি অনেকে মামলার কাগজপত্র দেখিয়েও প্রবেশের অনুমতি পাননি।

অন্যদিকে যারা জোরাজুরি করেছেন তাদেরকে আটক করা হয়েছে। অনেক পথচারীকেও সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়। তারা নির্দিষ্ট কারণ দেখানোর পরও ছাড়া হয়নি। পুলিশ জানায়, তাদেরকে প্রথমে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। যাচাই-বাছাইয়ে যদি মনে হয় তারা নির্দোষ তবে ছেড়ে দেয়া হবে। ওই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় আটক হন সদ্য মালয়েশিয়া ফেরত একব্যক্তি। তার সঙ্গে আটক করা হয় তার বন্ধুকেও। জোরাজুরি করে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় তাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন।

তিনি জানান, কোর্টের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পুলিশ আমাকে আটক করেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আরিফ ও শাওন নামে দুই সহোদর ভাই যাচ্ছিলেন হাইকোর্টের সামনে দিয়ে। এ সময় পুলিশের সন্দেহ হলে শাওনকে আটক করে। এ সময় তার ভাই আরিফ এগিয়ে এলে তাকেও আটক করে পুলিশ। শাওনকে পুলিশভ্যানে করে পাঠিয়ে দেয়া হয় শাহবাগ থানায়। এ সময় চিকিৎসার কাগজপত্রও দেখান শাওনের ভাই আরিফ। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। উল্টো আটক করে তাকেও তোলা হয় প্রিজনভ্যানে।

পরে প্রিজনভ্যানের ভেতর থেকে তিনি স্যার, স্যার বলে আকুতি জানাতে থাকেন। পরে আরিফ প্রিজনভ্যানের ভেতর থেকে সাংবাদিকদের জানান, তার ভাই শাওনের মাথায় টিউমার। অপারেশন করাতে হবে। আজ ডাক্তার দেখানোর জন্য তিনি ভাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। হাইকোর্টের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে আটক করা হয়। তার অভিযোগ চিকিৎসার কাগজপত্র দেখানোর পরও তাদের ছাড়েনি পুলিশ।

প্রিজনভ্যানে থাকা আরেকজন আটক বাবুল জানান, তার শুনানি ছিল। তাই তিনি কোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে আটক করে পুলিশ। তিনি আরো জানান, তার এক ভাই হাইকোর্টে চাকরি করেন। পরে ওই ভাই ও তার মা সেখানে এসে ছেড়ে দেয়ার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেন। এ সময় পুলিশ জানায়, থানায় যাওয়ার পর নির্দেশ প্রমাণিত হলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। চট্টগ্রামের জিনিয়া নামের এক নারী হাইকোর্টে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। এ সময় সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে আটক করা হয়।

তিনি জানান, মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে ওকালত নামায় স্বাক্ষর করার জন্য তিনি হাইকোর্টে প্রবেশ করছিলেন। একপর্যায়ে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিলেও তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। পুলিশ তাকে ওই স্থান ত্যাগ করতে বলেন। জিনিয়া জানান, উকিলের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছেন। পরে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে জবরদস্তি করে তাকে পুলিশভ্যানে তুলে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

রমনা বিভাগের ডিসি মারুফ হোসেন সরদার বলেন, কেউ কোনো ধরনের নাশকতা করতে না পারে, সে কারণে পুলিশ বাড়তি নিরাপত্তা নিয়েছে। অন্যদিক সন্দেহভাজন আটককৃতদের থানায় নিয়ে গিয়ে যাচাই-বাছাই শেষে নির্দোষ হলে ছেড়ে দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, গতকাল হাইকোর্ট এলাকা থেকে ৪০ পুরুষ ও ২ নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

উল্লেখ্য, এক এগারোর সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ৮ই আগস্ট এই মামলা করে দুদক। এতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী ও তার এপিএস জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম খানকে আসামি করা হয়। এই চারজনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।

অভিযোগ করা হয়েছে, তারা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতকে জানিয়েছেন, অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই দাবি করে তিনি বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। ২০১২ সালের ১৬ই জানুয়ারি আদালতে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০১৪ সালের ১৯শে মার্চ মামলার বিচার শুরু হয়। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে