বৃহস্পতিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ০১:৩১:১২

তিস্তা নিয়ে মমতা ব্যানার্জী কী ভাবছেন?

তিস্তা নিয়ে মমতা ব্যানার্জী কী ভাবছেন?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত : দেখতে দেখতে আট বছর চলে গেল। আট বছর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তিস্তাসহ অন্য সব নদীর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জি সেদিন তার সঙ্গে না গিয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রী নয়, ভারত তার বিদেশনীতি ও ভারতের সংবিধানকে অপমান করেছিলেন। অপমান করেছিলেন বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে।

ভেবেছিলেন পানিচুক্তি না হলে হাসিনা সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শুধু একা নন, তার মন্ত্রিসভার বহু সদস্য সেদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন— পানিচুক্তি হলে হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরবেন। কিন্তু তারা তা আটকাতে পারেননি। কারণ বাংলাদেশের জনগণ হাসিনাকে বিপুলভাবে ভোট দিয়েছিলেন।

বঙ্গেশ্বরী অভিযোগ করেছিলেন, মনমোহন সিং নাকি তাকে কিছু জানাননি। কিন্তু তিনি নিজেই জানেন, তা কতটা অসত্য। পরবর্তীতে বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি ঢাকায় গিয়ে সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। এই সময়ের মেয়াদ আর কতদিন? কারণ আর কয়েক মাস পরেই বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন। সেদিন মমতার সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগবিরোধী জামায়াত ও বিএনপি।

মুখ্যমন্ত্রী ভালো করেই জানেন, জামায়াত ও উত্তর বিহারের সন্ত্রাসবাদীরা কোথায় আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের কে আশ্রয় দিচ্ছে। এ ব্যাপারে যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য ফাইলবন্দী হয়ে সাউথ ব্লকে পড়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যদি সাহস থাকে তাহলে তারা পানি নিয়ে আর জলঘোলা করবেন না। মমতাদেবী মানুন না মানুন, দু’দুজন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদি ভারতের হয়ে ঢাকাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে পানিচুক্তি হবেই।

ঢাকা বারবার দিল্লিকে চাপ দিচ্ছে। কারণ বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে। সৌজন্যের তাগিদে দিল্লি মমতা ব্যানার্জিকে বারবার অনুরোধ করেছে। তিস্তা নদীর উৎস সিকিমে হলেও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের উত্তরদিকে ঢুকেছে। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং তিস্তার পানি দেওয়ার সম্মতি আগেই জানিয়েছেন। তাহলে কেন মাঝপথে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে পানিতে মারার চক্রান্ত হচ্ছে।

আমার মনে আছে, পেশাগত কারণে যখনই উত্তরবঙ্গে যেতাম তখন লোকের মুখে একটি ছড়া শুনতাম। জলপাইগুড়ির তিন টি। টি-টিম্বার এবং তিস্তা। তিস্তা পশ্চিমবঙ্গেরই ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। আন্তর্জাতিক আইন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার বোঝেন না বা বুঝতে চান না। তাই তারা বারবার বাংলাদেশকে পানিহীন করতে চাইছে। আট বছর অনেক সময়। এ সময়ের মধ্যে কেন পশ্চিমবঙ্গ কোনো সিদ্ধান্ত আনতে পারছে না?

উত্তর বিহারের যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারাই এখন মমতার পরামর্শদাতা। নেপথ্য কারণ মাইনরিটি ভোট-ব্যাংক। ঢাকা কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ পার্লামেন্টের ১০ জন সদস্যকে নিয়ে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে দিল্লি আসছেন। সেই সুযোগে তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর কলকাতায় এসে মমতাকেও বোঝানোর চেষ্টা করবেন বলে খবরে প্রকাশ।

আরও খবর, বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তিস্তা নিয়ে আলোচনার জন্য পৃথকভাবে এদেশে আসছেন। আট বছর ধরে দিল্লি ও ঢাকা পরস্পরের প্রতি আস্থা রেখে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা স্বীকার করে সমস্যা মেটানোর পক্ষে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। কথায় বলে না, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এখন ভোটব্যাংকই বড় কথা।

বাংলাদেশ স্বাধীন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উত্তর বিহারের সন্ত্রাসীরা আশ্রয় নিয়েছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। তারা আশ্রয় নিয়েছে কলকাতার আশপাশে সর্বত্রই। তাদের আশ্রয় বিনামূল্যে হয়নি। তাদের ধারণই হলো তিস্তাচুক্তি হলে হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের লাভজনক হবে। বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২০১২ সালে দিল্লিতে এসে ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে তিস্তাচুক্তি বাস্তবায়িত করার জন্য তদবির করেছিলেন।

বিএনপি নেতারা দিল্লি-কলকাতার পরিবর্তে বর্তমানে বেশিরভাগ সফর করছেন নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে তারা টুঁ শব্দটিও করছেন না। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের সব বিরোধী দল বামফ্রন্ট, কংগ্রেস বারবার দাবি তুলছে, অবিলম্বে তিস্তাচুক্তিতে রাজ্য সরকার সম্মতি দিক। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সেচ দফতরের প্রধান সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন করলাম, তিস্তাচুক্তি বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

ওই অফিসার বললেন, ‘এসব প্রশ্ন করবেন জানলে আপনার টেলিফোনই ধরতাম না।’ অফিসাররা এখানে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘দিদি’ বলেন। তিস্তা নিয়ে যা কিছু প্রশ্নের জবাব দিদিই দিতে পারেন। মমতার একান্ত ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ছাড়া জানা সম্ভব নয়, তিনি তিস্তা নিয়ে আসলে কী ভাবছেন।

মমতার নিযুক্ত নদী বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র প্রায় সাত বছর আগে তিস্তার পানি বণ্টনে পশ্চিমবঙ্গে যে খুব একটা অসুবিধা হবে না, তা তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন। সে রিপোর্টের কপিও রয়েছে ভারত সরকারের হাতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটু উদ্যোগ নিলেই মমতাকে বাদ দিয়েই এ চুক্তি করা যায়। এটি দুই দেশের ব্যাপার। কোনো অঙ্গরাজ্যের বিষয় নয়। যেমন ফারাক্কা চুক্তির সময় বাংলাদেশের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রাজ্জাক সাহেব সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে গিয়েছিলেন। জ্যোতিবাবু তাকে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা বরকত গনি খান চৌধুরীর কাছে পাঠিয়েছিলেন।

জ্যোতিবাবু ও বরকত সাহেবের মধ্যে আট বছর নয়, মাত্র আট মিনিট কথা হয়েছিল। আট মিনিটেই ফারাক্কা সমস্যার সমাধান তারা করে ফেলেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষও এ সমস্যা আর জিইয়ে রাখতে চাইছেন না। মালদহের কংগ্রেস সংসদ সদস্য আবু হোসেন খান চৌধুরী মনে করেন দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাস্তবে রূপ দেওয়া খুবই জরুরি। আমাদের দেশের নীতি, আদর্শ এবং সংবিধান আছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যদি সবকিছু লঙ্ঘন করেন, তাহলে বিদেশের কাছে আমরা মুখ দেখাব কেমন করে?

তার সুরেই কথা বলছেন উত্তর দিনাজপুরের সিপিএম সংসদ সদস্য মুহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, সিপিএম যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই সব ঠিকঠাক করে দিল্লিকে জানিয়ে দিয়েছিল। প্রবীণ সাংবাদিক, যিনি ৩০ বছর টেলিগ্রামে রাজনীতি নিয়ে কলাম লিখেছেন, সেই তরুণ গঙ্গোপাধ্যায় উত্তেজিত হয়ে বলেন, যারা আন্তর্জাতিক কানুন জানেন না, তারাই এখন ক্ষমতায় আছেন। তাদের ঔদ্ধত্য এপার বাংলার বাঙালিদের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হেয় করে তুলছে।

একাত্তরে আমরা যেমন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছি তেমনই ওপার বাংলার স্বার্থে তিস্তাচুক্তি দ্রুত রূপায়ণ করা হোক। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলের দৃঢ় বিশ্বাস নরেন্দ্র মোদির এবার একটু কঠোর অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। না হলে বঙ্গেশ্বরীর আপত্তিতে তিস্তাচুক্তি ঝুলে থাকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা হাস্যকর ঘটনা হিসেবে পরিণত হচ্ছে। - বিডি প্রতিদিন

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে