শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৫৪:২৬

বড়বাড়ী স্মৃতিসৌধে 'জীবিত অমর' খালেদা ও দুলু

বড়বাড়ী স্মৃতিসৌধে 'জীবিত অমর' খালেদা ও দুলু

রাজীব নূর ও ফরহাদ আলম সুমন: লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ীতে শহীদ স্মৃতিসৌধের ম্যুরালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছবির নিচেই আছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সেখানকার সাবেক সাংসদ আসাদুল হাবীব দুলুকে নিয়ে করা ম্যুরালটি। ২০০৪ সালে বিএনপি যখন সরকারে, তখন ওই সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপমন্ত্রী আসাদুল হাবীব দুলুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লালমনিরহাট জেলা পরিষদের উদ্যোগে বড়বাড়ীতে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে 'জীবিত অমর' খালেদা ও দুলুর ছবিসংবলিত স্মৃতিসৌধটি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। নির্মাণের সময় স্মৃতিসৌধ থেকে জীবিত নেতা-নেত্রীর ছবি অপসারণের দাবিতে মুখর লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগ এখন নিশ্চুপ। শুধু তা-ই নয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা পরিষদের প্রশাসক মতিয়ার রহমান স্পষ্টই বললেন, 'বড়বাড়ীর ভৌগোলিক অবস্থানটা এমন যে ওখানে কিছু করতে গেলে রক্তক্ষয় হবে।' নির্মাণ শেষ হওয়ার পর এক দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়নি স্মৃতিসৌধটির। লালমনিরহাট জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য নেওয়া প্রকল্পটি ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদন পায়। এর ব্যয় প্রথমে ১৫ লাখ টাকা ধরা হলেও পুনর্মূল্যায়ন করে ব্যয় ২৮ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৩ টাকা ধার্য করা হয়। ২০০৪ সালের নভেম্বরের দিকে স্মৃতিসৌধের প্রথম পর্যায়ের কাজ সমাপ্ত হলে ১১৯ শহীদের মধ্যে ৮৩ জনের নাম-পরিচয়সহ একটি ফলক স্থাপন করা হয়, যে ফলকের অস্তিত্ব এখন আর নেই। তবে সৌধের মূল বেদি থেকে সোজা উঠে যাওয়া ৩৮ ফুট উঁচু একটি স্তম্ভে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবীব দুলুকে নিয়ে করা ম্যুরালটি এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। বড়বাড়ী আইরখামার ডাকবাংলো মাঠে ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন ১১৯ বাঙালি। তাদের স্মরণে বড়বাড়ীর আর কে রোডের সাদেকনগর ত্রিমোহনীতে স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। যে শহীদদের স্মরণে ২০ শতক জমির ওপর স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন সাবেক উপমন্ত্রী দুলুর বাবা স্থানীয় পাংগাটারী লক্ষ্মী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বড়বাড়ী ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান শহীদ আবুল কাশেম, রংপুর কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্র সংসদের ভিপি মুখতার ইলাহী প্রমুখ। শহীদ মুখতার ইলাহীর বড় ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. কে মউদুদ ইলাহী বলেন, 'যারা আমাদের জন্য একটি দেশ, জাতি-পরিচয় ও পতাকা উপহার দিয়ে আত্মত্যাগ করে গেছেন, তাদের সশ্রদ্ধ সম্মান জানানোর জন্য এরূপ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রয়োজন আছে। জীবিতদের উদ্দেশে বা লক্ষ্য করে কখনও এমন নির্মাণকাজের প্রয়োজন হয় না। বিশ্বের কোথাও এমন নজির আছে বলে আমার জানা নেই। এখন যারা জীবিত, তাদের অবদান ও কৃতকর্ম বিচার করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মই নির্ধারণ করবে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে কি-না। জীবদ্দশায় নিজেরই তত্ত্বাবধানে স্মৃতিসৌধে নিজেদের ছবি আঁকিয়ে নেওয়া কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়।' আসাদুল হাবীব দুলু অবশ্য ছবি দিয়ে স্মৃতিসৌধের দলীয়করণ করা হয়েছে_ এমন অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি বলেন, এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লঙ্ঘিত হয়নি এবং স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাউকে স্থান দেওয়া হয়নি। তিনি জানান, অনুমোদনকৃত ডিজাইন ও থিম অনুযায়ী স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিসৌধের ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের (বর্তমানে অনুষদ) সাবেক জিএস এবং চারুকলা শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রুস্তম আলী প্রামাণিক। ডিজাইনার রুস্তম আলী প্রামাণিক বলেন, বড়বাড়ী স্মৃতিসৌধের স্তম্ভে টাইলস দিয়ে করা ম্যুরালে মুক্তিযুদ্ধকেই মূর্ত করা হয়েছে। তার দাবি, সৌধের নকশা করার সময় 'স্মরণীয় ও বরণীয়'_ এ ধারণা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। তাই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা এবং পরবর্তীকালে দেশ গঠন ও কৃষি বিপ্লবে শহীদ জিয়ার অবদান বোঝাতে তার দুটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে। নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ বোঝাতে বাংলা বর্ণমালা এবং শিক্ষাদানরত খালেদা জিয়ার একটি ছবি ব্যবহার করেছেন। নিরক্ষরমুক্ত প্রথম জেলা লালমনিরহাট এবং লালমনিরহাটের উন্নয়ন বোঝাতে উন্নয়নের রূপকার সাবেক উপমন্ত্রী দুলুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধে জীবিত মানুষের ছবি রাখায় ক্ষুব্ধ লালমনিরহাটের মুক্তিযোদ্ধারা। সরেজমিনে লালমনিরহাট জেলায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে এমন ক্ষোভের কথা শোনা গেছে। জেলার একমাত্র বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক বলেন, স্মৃতিসৌধে জীবিত কোনো মানুষের ছবি থাকা ঠিক নয়। এ কথা আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের লালমনিরহাট সদর উপজেলা কমান্ডে গিয়ে আলাপ হলো কমান্ডার আবুবকর সিদ্দিক, ডেপুটি কমান্ডার ফরিদ হোসেনসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তারা সবাই একবাক্যে স্মৃতিসৌধের ম্যুরালটি সংস্কারের দাবি জানালেন। ওই সময় সেখানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন বলেন, এটা করে দুলু সাহেব তার বাবা শহীদ আবুল কাশেমকে অপমান করেছেন। এটি স্মৃতিসৌধের দলীয়করণ। স্থানীয় সাংবাদিক ও কবি আবদুর রব সুজন বলেন, স্মৃতিসৌধটি যখন নির্মিত হয়, তখন লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন সাবেক সাংসদ আবুল হোসেন। ওই সময় বিবৃতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, স্মৃতিসৌধের দলীয়করণের জবাব একদিন জনতার আদালতে দিতে হবে। তিনি এখন স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে শয্যাশায়ী। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের এ নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের সময় খবর পরিবেশনের কারণে তাকেও অনেক হুমকির শিকার হতে হয়েছে জানিয়ে আবদুর রব সুজন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে গড়া এই স্মৃতিসৌধ এখনও ওই অবস্থায় রয়ে গেছে। এটা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এটি লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার নজির। এটি যদি ওই অবস্থায় থেকে যায়, তাহলে নতুন প্রজন্ম ভুল বার্তা পাবে। অবিলম্বে এটি পরিবর্তন করা হোক। কেননা, এটি নির্মিত হয়েছে সরকারি অর্থায়নে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা পরিষদের প্রশাসক মতিয়ার রহমানের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বড়বাড়ী এলাকায় এখনও বিএনপি-জামায়াতের আধিপত্য রয়েছে। এটি সাবেক উপমন্ত্রী দুলুর নিজের ইউনিয়ন এবং ওই ইউনিয়নে তার অনেক অন্ধ অনুসারী রয়েছে। কিছু করতে গেলে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতা ঘটতে পারে। তবে বড়বাড়ী আইরখামার ডাকবাংলো এলাকায় যেখানে একাত্তরে নির্মম গণহত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল, ঠিক সেখানেই আরেকটি স্মৃতিসৌধ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে জেলা পরিষদের।-সমকাল ২০ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে